আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা একা ও নিসঙ্গ এবং তোমাদের গোলাম ও বাঁদীদের মধ্যে যারা সৎ ও বিয়ের যোগ্য তাদের বিয়ে দাও। যদি তারা গরিব হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ আপন মেহেরবাণিতে তাদের ধনী করে দেবেন, আল্লাহর বড়ই প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নূর : ৩২)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, নবী সা:-এর সাথে আমরা কতক যুবক ছিলাম; আর আমাদের কোন কিছু ছিল না। এই হালতে আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখো, তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান হিফাজত করে এবং যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন সওম পালন করে। কেননা, সওম তার যৌনতাকে দমন করবে। (বুখারি : ৫০৬৬, ১৯০৫)
আমাদের বিয়েতে অনেকগুলো অপসংস্কৃতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব কুসংস্কার হঠাৎ উচ্ছেদ করা সম্ভব না হলেও ক্রমান্বয়ে এগুলো পরিহার করা উচিত। আমাদের দেশে কন্যা দেখা থেকে শুরু করে বাসরঘর পর্যন্ত এই অপসংস্কৃতিগুলো পবিত্র বিয়েতে সুপরিকল্পিত উপায়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
কনে দেখা অনুষ্ঠান : ছেলে পক্ষ ৪-৫ জন কনে দেখতে যান। তাদের মধ্যে সাধারণত ছেলের চাচা, মামা, বড় দুলাভাই বা ছোট বোন জামাই, এলাকার মাতব্বর বা কোনো মুরুব্বি এবং বিয়ের ঘটক উপস্থিত হন। এদের সামনে কনেকে সাজিয়ে আনা হয়। মেয়ের ঘুমটা খোলা হয়, হাতের কবজি, পায়ের গোড়ালি ও মাথার চুল খুলে দেখাতে হয়। মাঝে মধ্যে মেয়েকে হাঁটানো হয়। পছন্দ হলে কিছু টাকা অথবা আংটি পরিয়ে আসে। এগুলো ইসলামী রীতিনীতি নয়। কনে দেখার জন্য ছেলে, ছেলের বাবা বা মা যেতে পারেন।
মেয়ের বাড়িতে গেট প্রথার বিড়ম্বনা : বিয়েবাড়িতে গেট সাজানো হয়। গেটে টেবিল ফেলে কতগুলো মেয়েকে সাজিয়ে দাঁড় করানো হয়। নতুন বরকে অভ্যর্থনা জানানোর কিছু ফল, মিষ্টি ও শরবত মেয়েগুলোর হাতে দেয়া হয়। বরযাত্রীকে আটকিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। তাদের চাহিদামতো অর্থ দিলে তারা গেট খুলে দেবে। যদি চাহিদামতো না হয় বা গড়িমসি করা হয় তবে দীর্ঘসময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটি ইসলামী সংস্কৃতি বা সামাজিকতা নয়।
দেনমোহর নিয়ে দর কষাকষি : দেনমোহর কনের অধিকার, ছেলের সামর্থ্য অনুযায়ী এবং তাৎক্ষণিক পরিশোধ সাপেক্ষে দু’পক্ষের সমঝোতায় তা নির্ধারিত হবে। কিন্তু মেয়ের পক্ষ মনে করেন এটি মেয়ের জন্য তার রক্ষা কবজ। এমনভাবে মোটা অঙ্কের মোহরানা ধার্য করা যাতে ছেলে মেয়েকে ছেড়ে দিতে ভয় পায়। আবার ছেলের পক্ষের ধারণা যদি মেয়েকে কোনো দিন ছেড়ে দিতে হয় তখন যাতে অল্প টাকায় বিদায় করে দেয়া যায়, তাই তারা মোহরানা কম করতে চায়। এ নিয়ে উভয়পক্ষে চলে দরকষাকষি এবং অনেক সময় ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যায় এবং সমঝোতাও ভেঙে যায়। কিন্তু মোহরানার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি তাই? ইসলাম বলে মোহরানা হলো মেয়ের হক, যা ছেলে আদায় করে তবে মেয়ের কাছে যাবে এবং মোহরানা ছেলে-মেয়ের বুঝাপড়ার বিষয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারপর যে দাম্পত্য জীবনের স্বাদ তোমরা তাদের মাধ্যমে গ্রহণ করো, তার বদলে তাদের মোহরানা ফরজ হিসেবে আদায় করো। তবে মোহরানা চুক্তি হয়ে যাবার পর পারস্পরিক রেজামন্দির মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে যদি কোনো সমঝোতা হয়ে যায় তাহলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও জ্ঞানী।’ (সূরা নিসা : ২৪)
বর-কনের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা : কোনো পার্টি সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার অথবা গ্রামের শামিয়ানার নিচে বিশেষ স্টেজ তৈরি করে বর-কনের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। যা বেপর্দা ও বেহায়াপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। চারদিক থেকে অনুষ্ঠানে আগত ছেলে-মেয়ে ও আবালবৃদ্ধবনিতা ছবি বা সেলফি তোলার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এজন্য পিতা-মাতা বা অভিভাবকগণ অবশ্যই ‘দায়ুস’ হিসাবে চিহ্নিত হবেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে।
ওলিমা অনুষ্ঠানে উপহারের টেবিল স্থাপন : বর-কনে উভয়ের পক্ষ থেকে ওলিমা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমন্ত্রিত অতিথিগণের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও অন্যান্য উপহারসামগ্রী সংগ্রহের জন্য উভয়পক্ষ অনুষ্ঠানের পথে টেবিল স্থাপন করেন। মনে হয় যেন কোনো ওলিমা অনুষ্ঠান নয় বরং কোনো হালখাতার অনুষ্ঠান। এটি আন্তরিকতার পরিবর্তে উপহার বা টাকা-পয়সা সংগ্রহের বিশেষ আয়োজন। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, যাদের টাকা আছে তারাই শুধু ওলিমা অনুষ্ঠানে আসবে। অথচ সেই ওলিমা উত্তম যেখানে ধনীদের পাশাপাশি সমাজের গরিবরা উপস্থিত হবে। এ ধরনের হীন মানসিকতা মুসলমানদের পরিহার করা উচিত। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সারাজীবনের জন্য একটি পরিবার ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। তাদের দোয়ার জন্যই অনুষ্ঠানটি করা উচিত।
বিবাহের খুৎবা প্রদানের অনুপস্থিতি : জীবনে বহু বিবাহ দেখেছি কিন্তু কোনো বিবাহে খুৎবা প্রদানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ অনুষ্ঠিত হতে দেখিনি। বলতে গেলে সুন্নাহটি বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। ফলে আমাদের পারিবারিক জীবনে বরকত থেকে বি ত হচ্ছে। এটি রাসূলুল্লাহ সা: এর প্রসিদ্ধ সুন্নাহ। তাই আকদ অনুষ্ঠানের পূর্বেই খুৎবা প্রদান করুন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সময় খুৎবা প্রয়োজন আছে। (আবু দাউদ : ২১১৪, কিতাবুন নিকাহ, বাবু ফি খুৎবাতিন নিকাহ) আকদ অনুষ্ঠানের আগে হবু দম্পতিসহ আগত লোকদের সামনে কুরআন-হাদিসের আলোকে বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব, স্বামী-স্ত্রীর হক বা অধিকার নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করতে হবে। এ ধরনের খুৎবার জন্য প্রথমে হামদ ও ছানা পড়বে। তারপর কুরআন ও রাসূল্লাহর সা:-এর সুন্নাহর আলোকে বিশেষ করে সূরা নিসা : ১, সূরা আল ইমরান : ১০২, ও সূরা আহযাব : ৭০-৭১ অর্থসহ আলোচনা করবে। (আবু দাউদ :২১১৮) বিয়ের খুৎবা প্রদান রাসূলুল্লাহ সা:-এর একটি অন্যতম সুন্নাহ। খুৎবা বর দিতে পারলে ভালো হয় । কারণ তার কথা উপস্থিত অতিথিবৃন্দের মনে বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করবে। খুৎবায় সূরা নিসা : ১ আয়াতটি ব্যাখ্যাসহ শোনালে শ্রোতাগণ প্রভাবিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একটিমাত্র প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দু’জন থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু নারী ও পুরুষ। সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রাখছেন।’ (সূরা নাস : ১)
কোনো গায়ের মাহরিমকে উকিল বাবা নির্ধারণ : কোনো কোনো এলাকায় উকিল বাবা নামে তৃতীয় কোনো গায়ের মাহরিম ব্যক্তিকে নির্ধারণ করা হয় যা সুস্পষ্টভাবে ইসলামবিরোধী কাজ। উভয়পক্ষের অভিভাবকেরা এ ধরনের অনৈসলামিক কাজের জন্য আল্লাহর দরবারে ভয়ানকভাবে দায়ী হবেন। মেয়েটা যতবার উকিল বাবার সম্মুখে যাবে ততবারই বেপর্দার গুনাহে লিপ্ত হবে এবং পর্দা গুরুত্বপূর্ণ ফরজ কাজ ছেড়ে দেয়ার জন্য গোনাহগার হবে। আকদ অনুষ্ঠানে মেয়ের বাবা বা বড় ভাই বা অন্য কোনো মাহরিম ব্যক্তি দু’জন সাক্ষীর সামনে মেয়ের এজিন বা বিবাহের অনুমতি এনে ছেলের সামনে পেশ করবে, ছেলে স্পষ্ট উচ্চারণে কবুল বলবে বোবা হলে মাথার ইশারায় সম্মতি প্রকাশ করবে। প্রসঙ্গত কোনো কোনো এলাকায় কাজী অথবা বিয়ে পড়ানোর হুজুরকেও ভেতরে মেয়ের কাছে বিবাহের অনুমতির জন্য প্রেরণ করা হয়, এটিও ঠিক নয়।
এ ধরনের আরো বহুবিদ কুসংস্কৃতি আমাদের দেশের বিয়ে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এগুলো পরিত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক