শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১২ পূর্বাহ্ন

মুমিনের গুণাবলি

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
  • আপডেট সময় সোমবার, ১০ জুন, ২০২৪

মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সেরা ও সম্মানিত সৃষ্টি। মানুষের মধ্য থেকেই প্রেরণ করেছেন নবী-রাসূল। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজ কুদরতের হাতে, ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদি মানব আদম আ:-কে সিজদা করতে, স্থান দিয়েছেন জান্নাতে। মানবজাতির প্রতিই নাজিল করেছেন আসমানি গ্রন্থ। আল্লাহ তায়ালা চান মানব জাতি সিরাতুল মুস্তাকিমে চলুক এবং এমন গুণাবলি অর্জন করুক যার ফলে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তিতে থাকতে পারবে। কিন্তু দুনিয়ার মানুষগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল তাদের স্রষ্টার কথামতো জীবন পরিচালনা করছে, স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ মান্য করছে। আরেক দল তাদের স্রষ্টার কথামতো জীবন পরিচালনা করছে না, স্র্রষ্টার আদেশ-নিষেধ মান্য করছে না। যারা স্বীয় রবের নির্দেশমতো জীবন পরিচালনা করছে তারাই হলো আল্লাহর বান্দাহ এবং কামিল মুমিন। মুমিনের গুণাবলি : সূরা ফুরকানের ৬৩ নং থেকে ৭৪ নং আয়াতে বর্ণিত কামিল মুমিনের গুণাবলি-
সব কাজ-কর্ম আল্লাহর মর্জি অনুযায়ী করে : কামিল মুমিনের প্রথম গুণ হলো তার বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা এবং আচার-আচরণ সবই প্রভুর মর্জি মোতাবেক হয়। যেসব কাজ-কর্মে আল্লাহ তায়ালা রাজি নন সেসব কাজ তারা আদৌ করে না।
জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে : কামিল মুমিনের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চক্ষু, কর্ণ, হাত-পা ইত্যাদি আল্লাহর সামনে হীন ও অক্ষম হয়ে থাকে। আল্লাহভীতির কারণে তারা বিনম্র হয়ে ও দুর্বলভাবে চলাফেরা করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘রহমানের (আল্লাহর) বান্দাহ তারাই যারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ (সূরা ফুরকান-৬৩)
অজ্ঞ লোকদের কথার জবাব কটু কথা দিয়ে দেয় না : কামিল মুমিন তারা যারা মূর্খদের জবাবে নিরাপত্তার কথাবার্তা বলে, যাতে অন্যেরা কষ্ট না পায় এবং নিজেরা গুনাহগার না হয়। আল্লাহর বাণী- ‘যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদের সম্বোধন করে (কটু কথা) বলে, তারা এর প্রতিবাদ করে না; বরং প্রশান্তিমূলক কথাবার্তা বলে।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘মন্দের জবাবে তাই বলুন যা উত্তম।’ (সূরা মুমিনুন-৯৫)
নামাজে রাত কাটিয়ে দেয় : আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দাদের অন্যতম গুণ হলো তারা দিবস-রজনী আল্লাহর ইবাদতে রত থাকে। দিনের ভাগে শিক্ষাদান, দ্বীনি দাওয়াত, জিহাদ ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকে এবং রাতে আল্লাহর সামনে ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকে। সাহাবায়ে কেরামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল-দিবসে সৈনিক, রাতে দরবেশ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তারা রাত যাপন করে তাদের পালনকর্তার সামনে সিজদা করা অবস্থায় ও (নামাজে) দ-ায়মান অবস্থায়।’ (সূরা ফুরকান-৬৪) রাতের নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ অন্যতম। মহানবী সা: বলেছেন, ‘নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ো। কেননা, এটি তোমাদের পূর্ববর্তী সব নেক বান্দার অভ্যাস ছিল। এটি তোমাদের আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য দানকারী, মন্দ কাজের কাফফারা এবং পাপাচার থেকে নিবৃত্তকারী।’ (মাজহারি) হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, যে ব্যক্তি এশার নামাজের পর দুই অথবা ততোধিক রাকাত (নফল) নামাজ পড়ল, সে যেন আল্লাহর সামনে সিজদা ও দ-ায়মান অবস্থায় রাত কাটিয়ে দিলো। (কুরতুবি ১৩তম খ-, পৃষ্ঠা-৫৩) কালবি বলেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের পর দুই রাকাত এবং এশার পর চার রাকাত নামাজ পড়ল- সে যেন সিজদা ও দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে দিলো।
সদা জাহান্নামের ভয়ে ভীত থাকে : আল্লাহর প্রিয় বান্দারা সদা আল্লাহর আজাবের ভয়ে ভীত থাকে। আর আজাব থেকে বাঁচার জন্য তাঁর কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করে। আল্লাহ বলেন- ‘কামিল বান্দাহ তারা যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি হটিয়ে দিন।’ (সূরা ফুরকান-৬৫)
অযথা ব্যয় করে না : কামিল মুমিন অযথা এবং না হক পথে ব্যয় করে না। আর ব্যয় করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও কৃপণতা উভয়ই পরিহার করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘কামিল মুমিন হলো তারা যারা অযথা ব্যয় করে না এবং কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’ (সূরা ফুরকান-৬৭) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তুমি একেবারে ব্যয়-কুণ্ঠ হয়ো না এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-২৯)
ইবাদতে শিরক করে না : শিরক তাওহিদের বিপরীত। তাওহিদ সব সৎকাজের মূল, আর শিরক সব গর্হিত কাজের মূল।
উভয় জগতের সৌভাগ্যের সোপান হলো তাওহিদ, আর উভয়জগতের ধ্বংসের সোপান হলো শিরক। হজরত লোকমান আ: নিজের ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে (কাউকে) শরিক করো না। অবশ্যই শিরক মহা অন্যায়।’ (সূরা লোকমান-১৪) অন্য সূরায় ইরশাদ করেছেন-‘যদি আপনি শিরক করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন।’ (সূরা আল-জুমার-৬৫)
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না : কামিল মুমিনের অন্যতম গুণ হলো সে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না।’ (সূরা ফুরকান-৬৮) অন্য সূরায় ইরশাদ করেন- ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময় ছাড়া কাউকে হত্যা করল অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করার জন্য কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে কারো জীবন রক্ষা করল, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল।’ (সূরা মায়েদা-৩২)
ব্যভিচার করে না : কামিল মুমিন স্বীয় জীবনকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখে। ব্যভিচার করা তো দূরের কথা, এর ধারে-কাছেও যায় না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই তা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩২) অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘কামিল মুমিন ব্যভিচার করে না।’ (সূরা ফুরকান-৬৮) মহানবী সা: বলেন, ‘মানুষের চক্ষুদ্বয় ব্যভিচার করে, উভয়ের ব্যভিচার হলো বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিদান।’ (বুখারি- ৬৬১২)
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না : মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবিরা গুনাহ। কারণ এর ফলে অন্যের প্রতি অবিচার ও জুলুম করা হয় এবং অনেক অঘটন ঘটে। মহানবী সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার জন্য জাহান্নামের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত সে পা নাড়ানোরও শক্তি পাবে না।’ (ইবনে মাজাহ-২৩৭৩) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘মুমিন হলো তারা যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না, মিথ্যা ও বাতিল বৈঠকে বসে না।’ (সূরা ফুরকান-৭২)
বাজে বৈঠকে বসে না : মুমিন যখন খারাপ ও বাজে বৈঠকের পাশ দিয়ে যায় তখন ভদ্রতা ও গাম্ভীর্য সহকারে চলে। তারা এরূপ বৈঠকে যোগদান করে না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: একদিন ঘটনাক্রমে খারাপ বৈঠকের পাশ দিয়ে যান। তিনি সেখানে না দাঁড়িয়ে সোজা চলে যান। মহানবী সা: এ কথা জানতে পেরে বলেন, ‘ইবনে মাসউদ কারিম তথা ভদ্র হয়ে গেছে।’ এরপর তিনি তিলাওয়াত করেন- ‘তারা যখন অসার ক্রিয়া-কর্মের সম্মুখীন হয়, তখন সম্মান করে ভদ্রভাবে চলে যায়।’ (সূরা ফুরকান-৭২)
আল্লাহর বাণী শুনলে অন্ধ ও বধিরের ন্যায় হয়ে থাকে না। মুমিনদের যখন কুরআনের আয়াত ও আখিরাতের কথা শুনানো হয় তখন তারা অন্ধ ও বধিরের মতো নীরব হয়ে বসে থাকে না; বরং শ্রবণ শক্তি ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করে ও তদনুযায়ী আমল করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর যখন তাদেরকে তাদের পালনকর্তার আয়াতগুলো বোঝানো হয়, তখন তারা বধির ও অন্ধ সদৃশ আচরণ করে না।’ (সূরা ফুরকান-৭৩)
স্বীয় পরিবারের জন্য দোয়া করে : মুমিন তার সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী, পুত্র প্রমুখের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করে যেন তাদেরকে তার চোখের শীতলতাস্বরূপ করে দেন। হজরত হাসান বসরি বলেন, চক্ষু শীতল করার অর্থ হলো- আল্লাহর আনুগত্যশীল করে দেয়া। পরিবারের কর্তার জন্য এটিই কাম্য যে, তার সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রী, পুত্র আল্লাহর আনুগত্যশীল হওয়া, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থাকা এবং তার অনুগত হওয়া।
মুত্তাকিদের নেতা হওয়ার প্রত্যাশা করে : মুমিন অবশ্যই নেতা হতে চায়। তারা আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করে- হে আমাদের রব! আমাদেরকে মুত্তাকিদের নেতা করুন। অর্থাৎ আমাদেরকে এমন যোগ্য করে দিন, যাতে মানুষ ধর্ম ও আমলে আমাদের অনুসরণ করে এবং জ্ঞান ও আমল দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com