রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ অপরাহ্ন

ছেলেকে গ্র্যান্ডমাস্টার দেখার স্বপ্ন ছিল জিয়ার

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪

বাবার কারণেই ছোটবেলা থেকে জিয়াউর রহমানের ৬৪ চালের খেলায় মনোনিবেশ। দাবা নিয়ে ছিল তার বড় স্বপ্ন। ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে সেই স্বপ্ন অনেকটা পূরণ হয়েছে। এই পেশাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দাবাকে ঘিরেই ছিল তার পুরো জগৎ। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও কোনও এক অমোঘ টানে সাদা-কালো বোর্ড ছেড়ে যাননি। আর ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস; সেই ৬৪’র ঘরেই ঘুরপাক করার সময় জীবনপ্রদীপ নিভে গেলো তার। সাঙ্গ হলো ৫০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন।
এই জীবনে দাবার মাধ্যমেই পরিচিতি পেয়েছেন জিয়া। ঝুঁকি নিয়ে খেলার পাশাপাশি কোচিং করিয়ে সংসার টানতেন। মোহাম্মদপুরে কষ্ট করে ফ্ল্যাটও কিনেছেন। জানতেন দেশে দাবার ভবিষ্যতের দিকে তাকালে তেমন সুখকর কিছু নেই। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে অবস্থা তেমন একটা বদলায়নি। ভারতে খেলতে গিয়ে তাদের দাবাড়ুদের আর্থিক স্বচ্ছলতা দেখে আফসোসই করতেন। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে সেখানে দাবার যেভাবে পরিচর্যা হয়, তা বাংলাদেশে হলে অনেক আগেই গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা বেড়ে যেতো। এমন পরিস্থিতি মেনে নিয়েই আপন মনে খেলে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানের সহপাঠী বন্ধু আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার অন্য পেশায় ব্যস্ততার কারণে খেলায় ছিলেন অনিয়মিত। সেখানে ৫০ বছর বয়সী জিয়ার মগজে ছিল শুধুই দাবা।
জিয়া জানতেন দাবাকে পেশা হিসেবে নেওয়া কঠিন। তারপরও নিজের উত্তরসূরী একমাত্র ছেলে তাহসিন তাজওয়ারকেও দাবায় নিয়ে আসেন তিনি। যেন নিজের পরিবার থেকে দাবায় প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে। স্বপ্ন ছিল ছেলে যেন বাবাকেও ছাড়িয়ে যায়। তাই নিজেই ছেলের কোচ হয়ে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। অনেক দিন ধরে খেললেও তাহসিন এখনও আন্তর্জাতিক মাস্টার হতে পারেননি। এ নিয়ে কখনও প্রয়াত বাবা আক্ষেপ করেননি। শুধু বলতেন, ‘ও আস্তে ধীরে এগিয়ে যাক, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। নিজের মতো খেলুক। খেলতে খেলতে একসময় ভালো দাবাড়ু হবে। হয়তো গ্র্যান্ডমাস্টারও হতে পারবে।’
খেলার পাশাপাশি ছেলের লেখাপড়াতেও জোর দিতেন জিয়া। তাহসিন সেন্ট যোসেফ থেকে ও লেভেল পরীক্ষা দিয়েছেন। যার কারণে মাঝে বাবা-ছেলে খেলা থেকে একটু দূরে ছিলেন। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে ২০২২ এর পর এবারও বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে খেলবেন। যা নিয়ে জাতীয় দাবা চলাকালীন টেনশনও কম করেননি। কিন্তু অকাল মৃত্যু সব ল-ভ- করে দিয়েছে।
ইউরোপে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বাবা-ছেলে খেলবেন- এমনও পরিকল্পনা ছিল জিয়ার। সেটাতো হলো না। এখন বাবার অকাল মৃত্যু তাহসিনকে যেন মহাসমুদ্রে একা করে দিয়েছে। কে এখন তাকে দাবার নানান কৌশল শেখাবে? বাবার নিথর দেহের সামনে মাকে স্বান্তনা দেওয়ার সময় এমন কিছু হয়তো ভাবছিলেন তিনি। নিজেও অশ্রুসজল হয়ে স্বান্তনা খুঁজছেন। স্ত্রী তাসমিনা সুলতানা লাবন্য শুধু স্বামীর দাবা খেলার জন্য বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি করেননি। ঢাকার বাইরে পোস্টিং হলে কে দেখবে সবকিছু। নিজে ছিলেন খেলোয়াড়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে নিজের ক্যারিয়ারও হয়নি। তাই জিয়ার সঙ্গে সবসময় লেগে থাকতেন। খেলার সময় তো আসতেনই। অন্যসময় দাবাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান।
বলতে গেলে তিন সদস্যের পরিবারকে দাবা অন্তঃপ্রাণ বললে ভুল হবে না। কিন্তু শুক্রবার সেখান থেকে একটি মূল্যবান তারকা খসে পরলো। স্ত্রী লাবন্য আর ছেলে এখন শোকে পাথর। তবে লড়াই করে তারা এই পর্যন্ত এসেছেন। কোনও প্রতিকূলতা তাদের আটকাতে পারেনি। বাবা জিয়ার অকাল প্রয়াণে চারদিক এখন অন্ধকার। তবে বাবার স্বপ্ন ছেলে একদিন গ্র্যান্ডমাস্টার হবে। বাংলাদেশে তার রেকর্ড ২৫৭০ রেটিংকেও ছাড়িয়ে যাবে। হবে সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার। মা লাবন্য হয়তো সেই স্বপ্ন পূরণে নতুন করে লড়াইয়ে নামবেন। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে একসময় তাহসিনকে নিয়ে এগিয়ে যাবেন বহুদূর। দূর আকাশ থেকে জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদ নিশ্চয়ই থাকবে…।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com