ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমাদের সংবিধানের কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে কোটার ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। তিনি চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন আরো বলেন, এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের সন্তানদের আন্দোলন। এই আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ জনগণের রুটি-রুজির সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে সবার সমান সুযোগের কথা বলা আছে সংবিধানে। কোথাও কোটার কথা নেই। সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে গত সোমবার মানবজমিনে তার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। মানবজমিনের সৌজন্যে ড. আসিফ নজরুল গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরা হলো।
তিনি বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশে চাকরি নেই। এখন আপনি সারা বছর কষ্ট করে পড়াশোনা করে এসে যদি দেখেন আপনার জন্য দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেছে তখন আপনি তো আন্দোলন করবেনই। এখন কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের তো এই দেশের জন্য বিরাট অবদান আছে সেজন্য কোটা। তাদের সবিনয় বলতে চাই মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই অবদান আছে, অনেক বড় অবদান আছে। তাদের প্রতি আমরা সারা জীবন কৃতজ্ঞ। তাদের জন্য সরকার বিভিন্ন পদবি করেছে; বীরশ্রেষ্ঠ, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক।
তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা আছে, তাদের জন্য বিশেষ সম্মান, বিভিন্ন সুবিধার কথা আছে। এই সুবিধা দেয়ার কথাই আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ১৫-তে বলা হয়েছে। এটাকে বলে সামাজিক নিরাপত্তা। সামাজিক নিরাপত্তা মানে হচ্ছে যারা আর্থিকভাবে দুরবস্থায় আছে তাদের জন্য রাষ্ট্র অর্থের সংস্থান করবে। যেটা মুক্তিযুদ্ধ ভাতা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের সংবিধানের কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকরিতে কোটার ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। চাকরি সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান আমাদের সংবিধানে আর্টিকেল ২৯ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, চাকরি সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে সবার সুযোগের অধিকার সমান। শুধুমাত্র নারী শিশু এবং সমাজে যারা অনগ্রসর শ্রেণি আছে তাদের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারবে। এটা বলা হয়েছে।
সংবিধান নিয়ে যখন আলোচনা হয়, গণপরিষদ বিতর্কে কোনো জায়গাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর শ্রেণি বলা হয় নাই। মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বা যে সকল মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কথা বলা আছে। আর্টিকেল ১৫-তে উনাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন ভাতা দেয়া। কিন্তু চাকরি দেয়ার জন্য কোথাও বলা নেই। এমনকি গণপরিষদ বিতর্কে একবারও কোনো মানুষ এটি উত্থাপন করেনি। তো মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর দেখানো তো সংবিধানবিরোধী। ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর বলা তো তাদেরকে অপমান করা।
তবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বঙ্গবন্ধু একটি কোটার ব্যবস্থা করেছিলেন এটা সত্যি। এটা ১৯৭৩ সালে উনি করেছিলেন ১৯৭২ সালের একটি আইন দ্বারা। তবে ওই আইনটিতেই বলা আছে, এটি অস্থায়ী আইন। এটা অস্থায়ী ওই সময়ের জন্য করেছেন যারা জাস্ট যুদ্ধ করে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধার ছেলেরা কী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতিরা কী মুক্তিযুদ্ধ করেছে? তাহলে সংসদ সদস্যের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখেন। মন্ত্রীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখেন। একুশে পদকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখেন। সবই রাখেন। শুধু সরকারি চাকরিতে কেন?
তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে ৬২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অরজিনিয়াল যে তালিকা ছিল সেটাকে এই সরকারের আমলে বাড়িয়ে তিনগুণ করা হয়েছে। এটা একটি দুর্নীতিবান্ধব ব্যবস্থা। সংবিধানবিরোধী ব্যবস্থা। এটা একটি চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। সেটার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করবে না? তাদের সারা জীবনের যে চাকরির অধিকার, জীবনে যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অধিকার সেটাকে আপনি নিয়ে নেবেন আর তারা সেটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে না?
তিনি বলেন, আমি এ আন্দোলনের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং আমি মনে করি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা যতভাবে পারি সম্মান করবো ওনাদের ভাতা আরও বাড়িয়ে দেয়া হোক। যেটা বঙ্গবন্ধু ওই সময় অস্থায়ী হিসেবে করেছেন। ওটা ওই সময় মিটমাট হয়ে গিয়েছে। অস্থায়ী জিনিসকে ৫০-৫২ বছর পর পুনর্বহন করতে পারেন না।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, আদালতের বিষয়ে সরকারের কিছু করণীয় নাই এটা আমি মনে করি না। অ্যাটর্নি জেনারেলের যে অফিস আছে যাদের আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে আপত্তি জানানোর কথা ওনারা তো আদালতের অংশ না ওনারা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অংশ। সরকারের অংশ। উনারা যদি রিসার্চ করে হাইকোর্টের এই ডিসিশনের বিরুদ্ধে আপিলেট ডিভিশনে দাঁড়ান আমি মনে করি ন্যায়বিচারের স্বার্থে অবশ্যই আপিলের ডিভিশন ওনাদের কথা শুনবেন এবং হাইকোর্টের আদেশটি বাতিল করবেন।
তিনি বলেন, আমি ৩০-৩৫ বছর ধরে সাংবিধানিক আইন পড়াই। আমি সাংবিধানিক আইনের ওপর বিনয়ের সঙ্গে বলি, কোনোভাবেই মুক্তিযোদ্ধার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না। কোনোভাবেই কমনসেন্সে যায় না এটা। পৃথিবীর কোনো দেশে এই সিস্টেম নাই। অনেকে হয়তো বলে পৃথিবীর কোনো দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে ইন্দোনেশিয়াতে, ভিয়েতনামে, মেক্সিকোতে, আমেরিকাতে, জিম্বাবুয়েতে হয়েছে, আপনি একটা উদাহরণ দেখান যেখানে চিরস্থায়ীভাবে মুক্তিযোদ্ধার কোটা করে চাকরি দেয়া হচ্ছে। এই বিষয়গুলো ভালোভাবে রিসার্চ করে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস যদি আপিলেট ডিভিশনে দাঁড়ান তাহলে এটা আপিলেট ডিভিশনের টেকার কোনো কারণ দেখি না।