১৯৬৬ সালে তৎকালিন পাকিস্থান সরকার জল বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরীর লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করার ফলে কর্ণফুলী বা কাপ্তাই হ্রদের সৃষ্টি হয়। শুরুতে কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটি জেলাবাসির জন্য কষ্টের কারণ হলে বর্তমান এ হ্রদ জেলাবাসির জন্য আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাঙামাটি জেলায় কাউখালী ও রাজস্থলী উপজেলা ব্যতিত বাকি আটটি উপজেলার প্রায় সকল ধরনের যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের নৌপথ। রাঙামাটি সদর, বরকল, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায় মৎস্য চাষ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি-অফিস, স্কুল-কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের একমাত্র যাতায়াত মাধ্যম নৌপথে করতে হয়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদ অবৈধ দখল ও দুষণ মুক্ত ছিলো। ১৯৮১ সালের দিকে কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে অবৈধ দখলদারদের বসতি স্থাপন এবং হ্রদ দুষণ শুরু হয়। ২০২৪ সালে এসে কাপ্তাই হ্রদের ওপর লক্ষাধিক অবৈধ স্থাপনা এবং হ্রদের দুষণ অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। রীট পিটিশন নং ১১৮৮৫/২০২২ মুলে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে বে-আইনী স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জবরদখল বন্ধে তাদের নিষ্ক্রিয়তা বা ব্যর্থতা রোধে আইনানুগ নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে রীট মামলা দায়ের করেন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর পক্ষে সম্পাদক, এডভোকেট মোঃ সরওয়ার আহাদ চৌধুরী ও এডভোকেট রিপন বাড়ৈই, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ, হল নং ০২, সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ভবন, ঢাকা, বাংলাদেশ। তাদের আবেদন আমলে নিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ার্দী উভয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট, বাধ নির্মাণ, বেআইনী দখল রোধ সকল অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে ১৭/১০/২০২২ ইংরেজি তারিখ এক নির্দেশনা দেন। কিন্তু কাপ্তাই হ্রদ ভরাট, বাধ নির্মাণ, বেআইনী দখল রোধ সকল অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা দুই বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। স্থানীয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এর নিরবতার কারণে কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে নতুন করে আরো হাজার-হাজার নতুনভাবে স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সরকারের সময়কালিন রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে বে-আইনী স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জবরদখল বেশী হয়েছে। এসব বে-আইনী স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং জবরদখল বন্ধে রাঙামাটির সকল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা পরেও উচ্চ আদালতের রায় বা নিদের্শ বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে বরকল, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর ও রাঙামাটি শহরে অবৈধভাবে কাপ্তাই হ্রদের জায়গা দখল করে প্রভাবশালি মহল গড়ে তুলেছে হোটেল, মোর্টেল, সুপার মার্কেট, সরকারি-বে-সরকারি অফিস, স্কুল-কলেজ, ক্লাব ঘর, রাজনৈতিক অফিস, ব্যবসায়ীক বহুতল ভবন, আবাসিক ভবন, আদা পাকা স্থাপনা ও কাঁচা ঘর-বাড়ি ইত্যাদি। নিয়মনীতি কোন ধরনের তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালি মহল অনেক স্থানে কাপ্তাই হ্রদ অবৈধভাবে দখল করে তাতে মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মান করে বিনাবাঁধায় ভোগ করছে রাষ্ট্রের সম্পদ। অবৈধ ভাবে হ্রদ বা লেক দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটিতে আলোচনা হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ প্রভাবশালি মহলের চাপে স্থানীয় প্রশাসন হ্রদের জায়গা এবং হ্রদের পাড় দখলদারদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করতে অদ্যবধি পারেনি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ১৬ বছরে পাল্লা দিয়ে রাঙামাটি শহরের রিজার্ভবাজার, তবলছড়ি, বনরুপাসহ কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে গড়ে উঠেছে হাজার-হাজার বহুতল ভবন। অথচ বাংলাদেশ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত তালিকায় কর্ণফুলি নদী (কাপ্তাই হ্রদ) দুষণমুক্ত,অবৈধদখল/স্থাপনা নাই এবং নদীর তীরে কোন বাজার/শিল্প কারখানা নাই বলে উল্লেখ করেছে। এসব দেখার জন্য রাষ্ট্র বা সরকার স্থানীয় ভাবে যে সব প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও কাপ্তাই হ্রদের জায়গা দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এবিষয়ে জানতে বাংলাদেশ জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান এর মুঠেফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি ফোন রিসিভ করে দুপুরের খাওয়ার কথা বলে কিছুক্ষণ পরে যোগাযোগ করতে বলেন, তার পরে তিনি আর ফোন রিসিভ না করায় কর্ণফুলি নদীর বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় নদী কমিশনের উল্লেখিত মন গড়া তথ্য প্রদানের বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি। রাঙামাটি বিএফডিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলন, আমাদের অফিসের কাছাকাছি গর্জনতলী এলাকায় আওয়ামীলীগের প্রভাবশালিরা নদীর ওপর অবৈধভাবে ক্লাব ঘর নির্মান করেছে, আমরা বাঁধা দেয়ার কারণে প্রভাবশালিরা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এখানে চাকুরী বাঁচানো ফরজ বলে তিনি জানান। এবিষয়ে বৈষম্যবিরোধী নাগরিক সমাজ এর সহ সমন্বয়ক ও সমাজ সেবক জুঁই চাকমা বলেন, কর্ণুফুলী নদী ও কাপ্তাই হ্রদে দুষণ,অবৈধ দখল/স্থাপনার উচ্ছেদ করতে হলে আন্তর্র্বতীকালিন সরকারের অধিনে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, বিচার বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএফডিসি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী উপকেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি জেলা প্রশাসন ও ১০ উপজেলার প্রশাসন, রাঙামাটি জেলা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, রাঙামাটি জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি.ফায়ার সার্ভিস প্রতিনিধি, জেলা ও উপজেলা জনস্বাস্থ্য, রাঙামাটি পৌরসভা, বাঘাইছড়ি পৌরসভা, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, বিজিবি, নৌ পুলিশ, জেলায় অবস্থিত সকল গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, আসনার ও ভিডিপি, পর্যাটন করপোরেশন, সকল নৌ যানের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি, হোটেল-মোর্টেল মালিক, চেম্বার অব কর্মাস, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, জেলেদের প্রতিনিধি. জেলায় অবস্থিত বাজার সমুহের কমিটির প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাঙামাটি জেলায় কর্মকান্ড রয়েছে এধরনের জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, পরিবেশবাদি সংগঠনের প্রতিনিধি, বৈষম্যবিরোধী নাগরিক সমাজ এর প্রতিনিধি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্রতিনিধি ও জেলায় কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীদের ইত্যাদি সংস্থার.সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে প্রতি মাসে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলে কয়েক বছরের মধ্যে কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই হ্রদে দুষণ,অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, রাঙমাটিতে আওয়ামীলীগের লোকজনের অবৈধ স্থাপনা বেশী হবে,তাদের দেখে অন্যেরাও অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলার সাহস পেয়েছে, গত ১৬ বছরে স্বৈরাচারী হাসিনার দলীয় লোকেরা রক্ষক ভুমিকা পালন না করে ভক্ষকের ভুমিকা পালন করেছে। বৈষম্যবিরোধী নাগরিক সমাজ এর সহ সমন্বয়ক জুঁই চাকমা কর্ণফুলী নদী ও কাপ্তাই হ্রদে দুষণ,অবৈধ স্থাপনা দ্রুত উচ্ছেদের জন্য আন্তর্র্বতীকালিন সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।