আবদুল হাই আল-হাদি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। সামান্য আয়ে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে কোনোরকমে তাঁর সংসার চলে। তাঁর নবম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে জুলকারনাইন পড়ালেখায় ভালো। ছেলে বড় হয়ে ভালো কিছু করবে, এমন স্বপ্ন দেখতেন আবদুল হাই।
কিন্তু আবদুল হাইয়ের সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে জুলকারনাইন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সাভারে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে যোগ দেয় জুলকারনাইন। বাইপাইলের পলাশবাড়িতে বিকেলে গুলিতে নিহত হয় সে।
জুলকারনাইন সাভারের পলাশবাড়ি জেএল মডেল স্কুল অ্যান্ড গার্লস কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ত। তাদের গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নের স্বরূপ গ্রামে। ৬ আগস্ট গ্রামের বাড়িতে জুলকারনাইনকে দাফন করা হয়। পরে তার পরিবারের সদস্যরা সাভারে চলে যান।
গত সোমবার মুঠোফোনে কথা হয় আবদুল হাইয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট ছেলেকে বাইরে যেতে দেখে বললাম, যেও না। বাইরের অবস্থা ভালো নয়, কখন কী হয়, বলা যায় না। কিন্তু সে বলল, “তুমিই তো আমাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছ। আমার ভাই–বোনেরা মারা গেছে। আমি বিজয় মিছিলে যাব।” বিকেল পাঁচটার দিকে তার বন্ধুরা মুঠোফোনে বলে, জুলকারনাইনের গলায় গুলি লেগেছে। দ্রুত সাভারের এনাম হাসপাতালে আসতে বলে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে।’
কাঁদতে কাঁদতে আবদুল হাই আল-হাদি বলেন, ‘ছেলেটা সেই যে বিজয় মিছিলে গেল, আর ফিরল না। ওকে ঘিরে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। শুনেছিলাম, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ সবচেয়ে ভারী। এখন সেই ভার আমার কাঁধে। আমি ছেলে হত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই।’ জেএল মডেল স্কুল অ্যান্ড গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ জামাল হোসাইন মুঠোফোনে বলেন, ‘জুলকারনাইন অত্যন্ত বিনয়ী ও মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। ৫ আগস্ট রাতে ওর মৃত্যুর খবর পাই। ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। আমরা যতটুকু পারছি, ওদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
এ দিকে সাঁথিয়া পৌর কার্যালয়ের পাশে জুলকারনাইনের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি ম্যুরাল প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ওই স্থানে আগে সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও স্থানীয় পৌর মেয়রের ছবি বাঁধানো ছিল। সরকার পতনের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ওই ছবি ভেঙে ফেলে। স্থানটি জুলকারনাইন চত্বর হিসেবে ঘোষণা করা হয়।সাঁথিয়া উপজেলা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি আসলাম উদ্দিন খান বলেন, দএই আন্দোলনে জুলকারনাইন এ উপজেলার একমাত্র শহীদ। তার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে সাঁথিয়ার সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা সাঁথিয়া পৌর পার্কে তার নামাঙ্কিত স্তম্ভটি করেছে। এ ছাড়া তার গ্রামে তার নামে একটি পাঠাগার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জুলকারনাইনের চাচা স্থানীয় গোপালপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক লোকমান হাকিম বলেন, এলাকার সবার কাছে জুলকারনাইন বীরের স্বীকৃতি পেয়েছে। এভাবে চলে যাওয়ায় পরিবারটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। টানাটানির সংসারে মা–বাবা ওকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন।