বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী মালিক ও বহিরাগত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর নিজেদের কারখানার কিছু অসাধু শ্রমিক কর্মচারী দিয়ে অযৌক্তিক দাবি-দাওয়া উত্থাপনের মাধ্যমে অন্তর্র্বতী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য নানা অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশী-বিদেশী চক্রের গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এতে তৈরী পোশাক শিল্পে অস্থিরতা কাটছে না। বেতন বৃদ্ধিসহ নানা দাবিতে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। একে পুঁজি করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে পানি ঘোলা করার চেষ্টা দেখছেন অনেকে। এ সঙ্কট দ্রুত শক্তভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাকশিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা কয়েক দিন ঢাকা, গাজীপুর, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন দাবি আদায়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভে বিপর্যস্ত তৈরী পোশাক শিল্প। প্রথম দিকে শ্রমিকদের দাবিকে পাত্তা না দিয়ে উসকানিদাতা, বহিরাগত হামলাকারী ও ঝুট ব্যবসায়ীদের দায়ী করে মালিকপক্ষ। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শ্রমিকদের দাবি আংশিকভাবে মেনে নেয়া হয়। তত দিনে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
গত শনিবার বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নুরুল কাদির অডিটোরিয়ামে আশুলিয়ায় তৈরী পোশাক কারখানাগুলোর চলমান সঙ্কট ও উত্তরণের পথ নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়। এ সভায় শ্রমিক অসন্তোষের জন্য তিনটি কারণ দায়ী বলে উল্লেখ করেন সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো: মঈন খান। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে বহিরাগতদের আক্রমণ-ভাঙচুর, শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা ও ঝুট ব্যবসার আধিপত্য। এ দিকে শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন, তৈরী পোশাকশিল্প কঠিন সময় অতিক্রম করছে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে একদিকে কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্য দিকে বিদেশী ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রফতানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টে হামলা, ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ করা হচ্ছে। এ বিক্ষোভের সাথে সাধারণ শ্রমিকদের দূরতম সম্পর্কও নেই। তিনি আরো বলেন, রফতানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিকনেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে।
শ্রমিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কারো প্ররোচনায় পড়ে কারখানায় ভাঙচুর চালাবেন না। শ্রমিকদের যেকোনো ন্যায্য দাবি সরকার-শ্রমিক-মালিকরা কারখানার অভ্যন্তরে বসে সমাধানে প্রস্তুত আছে। এসব দাবি কারখানাতেই সমাধান সম্ভব। রাজপথে কোনো সমাধান নেই।
শিল্পসংশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, অস্থিরতা প্রাথমিকভাবে কয়েকটি নির্দিষ্ট কারখানায় অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এরপর তা অব্যাহতভাবে বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে সাভার, আশুলিয়া ও জিরানীতে অবস্থিত পোশাক কারখানাগুলো ২০ দিন ধরে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান শিকারে পরিণত হয়েছে। তাদের মতে, এসব কারখানার মালিকেরা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ছিল। তারা প্রায়ই গত তিন বছরে মজুরি বৃদ্ধি স্থগিত করেছে, ব্যবস্থাপনা কর্মীদের বেতন অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করেছে। তারা কর্মীদের মাতৃত্ব ও অর্জিত ছুটি প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অভিযোগ পোশাক শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে বলে তারা মনে করছেন।
নাসা গ্রুপের কারখানায় অস্থিরতা ছিল সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা বিন্দু। কয়েকদিন পরে, নাসা গ্রুপের শ্রমিকরা হা-মীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, অনন্ত গার্মেন্ট, আল মুসলিম, বেক্সিমকো গ্রুপ, স্টার্লিং গ্রুপ, এনভয় গ্রুপ, নিউএজ গ্রুপসহ আরো কয়েকটি বড় কারখানায় হামলা শুরু করে। এসব হামলায় উসকানি দিয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী অথবা সমর্থক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতা উল্লেখ করেছেন যে, কিছু বড় কারখানার মালিক তাদের শ্রমিকদের ব্যবহার করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। তারা পরিস্থিতির ভুল ধারণা করেছিল। ফলে গতি পরিবর্তিত হয়ে আন্দোলন দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আশুলিয়ার খেজুরবাগান এলাকার রেডিয়েন্স জিন্স অ্যান্ড ফ্যাশন কারখানার সিনিয়র ম্যানেজার ওয়াহিদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, তাদের কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। অথচ আমাদের শ্রমিকদের কোনো দাবি-দাওয়া নেই। বহিরাগতরা এসে অস্থিরতা ছড়ায়। এ অবস্থায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছি আমরা। তবে পরিস্থিতি উন্নত হলে কারখানা চালু করা হয়েছে। মূলত বাইরের শ্রমিকদের দিয়ে একটি পক্ষ বিক্ষোভ ও আন্দোলন করাচ্ছে উল্লেখ করে ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকদের বিক্ষোভে কোনো সমর্থন ছিল না। তবু একটি পক্ষ বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিল্প পুলিশের কাছে অনুরোধ করব, যাতে যৌথ অভিযান চালিয়ে এদের দমন করা হয়। না হয় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে আমাদের পোশাকশিল্প।’
আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি নাজমা আক্তার নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘এটি একটি সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন নয়, কারণ বেশির ভাগ দাবি টিফিন বিল, রাতের ভাতা এবং উপস্থিতি বোনাসের মতো বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে।
নাজমা আক্তার উল্লেখ করেন যে, আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিক নেতারা স্থানীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত, মূলত আওয়ামী লীগের সাথে। তার মতে, শুধু শ্রমিক নেতারাই নয়, আশুলিয়ার কিছু কারখানার মালিকও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত, তারা দেশের পোশাক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বর্জ্য কাপড়ের (ঝুট) ব্যবসাও রাজনৈতিক কারণে প্রভাবিত হয়।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, সাভার, আশুলিয়া ও জিরানির আরএমজি বেল্টে প্রায় ২২০টি শ্রমিক সমিতি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তবে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারখানার মালিক অস্থিরতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সাথে যেসব কারখানার মালিক জড়িত ছিলেন তাদের কারখানায় বিভিন্ন সমস্যা জিইয়ে রেখেছেন। তাদের অনেক অমীমাংসিত সমস্যা এবং অর্থ প্রদানে বিলম্বের কারণে মারাত্মক অস্থিরতার সম্মুখীন হয় পোশাক শিল্প।
জলি তালুকদার বলেন, ‘আত্মগোপনে বা কারাগারে থাকা এসব কারখানার মালিকরা যদি সমস্যার সমাধান করতে চান, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই তা করা সম্ভব।’ তিনি উল্লেখ করেন যে, উদ্যোক্তারা শ্রমিকদের সব দাবির সাথে না হলেও কিছু দাবির সাথে একমত পোষণ করেন। যেমন রাতের শিফটে ভাতা প্রদান এবং মাসিক মজুরি যথাসময়ে প্রদান নিশ্চিত করা।
মাঝখানে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবার শুরু হয় শ্রমিক আন্দোলন। এরপর প্রতিদিনই বিক্ষোভ লেগে ছিল। দাবি আদায়ে কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটে। সহিংসতা ও ক্ষতি এড়াতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনেক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত দুই দিন পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক হয়েছে। এতে বন্ধ কারখানাগুলোও চালু হয়েছে। কিন্তু গতকাল থেকে আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি।