‘তোমার বয়স হয়েছে মা,সবসময় ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করবে’-এভাবে প্রায়ই মায়ের খোঁজ নেয় ছেলে পলাশ। সর্বশেষ ১৯ জুলাই মা’কে ফোন করে ডিম সিদ্ধ করে খেতে বলেছিলেন। মা ডিম খেয়েছিল। মা’কে বলেছিলেন খুব শিগগির বাড়ি ফিরবেন। বাড়ি ফিরেছেন ঠিকই কিন্তু লাশ হয়ে। ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা অশ্রুসিক্ত কন্ঠে এ কথা গুলো বলছিলেন পলাশের মা বেনু বেগম।
গত ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নং- গোলচত্তরে সারাদেশে কোঠা সংস্কারের জন্য ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ফিরোজ তালুকদার পলাশ বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। পলাশের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর পৌরসভার ঘাটান্দি এলাকায়। ছেলেকে হারিয়ে যেন পুরো পরিবারেই অন্ধকার নেমে এসেছে। সরেজমিনে শহিদ পলাশের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে এখনো সুনসান নিরবতা। কাঁচা টিনসেট ঘরে পলাশের মা বসবাস করেন। পলাশের মা বেনু বেগম (৬০) ছবি হাতে বসে রয়েছে। বেনু বেগম ও শহিদ পলাশের বাবা মৃত সোহরাব তালুকদারের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তিনভাই-বোনের মধ্যে পলাশ ছিল বড়। সবাইকে পাওয়া গেলেও পলাশের স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি বাড়িতে। স্বজনরা জানিয়েছেন, স্বামীর অবর্তমানে সন্তানের মুখে খাবার দেয়ার জন্য পলাশের মৃত্যুর কয়েকদিন পরই ঢাকায় কর্মযুদ্ধে চলে যান স্ত্রী রেশমা সুলতানা।
পলাশের মা বেনু বেগম সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলেন,পলাশ ঢাকার মিরপুর-১২ এলাকায় রংপুর কেমিক্যাল কোম্পানিতে অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করতো। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সারাদেশে শিক্ষার্থীদের কোঠা সংস্কার আন্দোলনে সারাদেশ যখন টালমাটাল ঠিক তখনই আমার সাথে দেখা করতে পলাশের মন অস্থির হয়ে ওঠে। স্ত্রী সন্তানদের বাঁধা উপেক্ষা করেই মায়ের সাথে দেখা করতে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর গ্রামের বাড়ির আসার জন্য রওনা দেয় পলাশ। এসময় মিরপুর ১০নং- গোলচত্তরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে পলাশের বুকে গুলিবিদ্ধ হয়। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন পলাশ। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে মিরপুরের আলোক হেলথ কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওই দিন গভীররাতেই অ্যাম্বুলেন্সযোগে পলাশের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার সকালে জানাজা শেষে ঘাটান্দির তালুকদার বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয় পলাশকে। শহিদ পলাশের মা আরো জানান, আমি ছেলের হত্যার বিচার চাই। আমার নাতনি, ছেলের বউ তাদের ভবিষ্যত কি হবে। যারা আমার বাবার বুকে গুলি করেছে তাদের যেন কঠিন শাস্তি হয়। আর সেটা যেন আমি দেখে যেতে পারি। এটাই আমার এক মাত্র চাওয়া।
ছোট ভাই শাহ আলম তালুকদার টুটুল জানান, আমার ভাই খুবই বিনয়ি ও পরোপকারী ছিলেন। আল্লাহ যেন ভাইকে জান্নাতবাসী করেন। তারা আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ খেকে ২ লাখ টাকা এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি।
স্বামীর শোকে পাথর রেশমা সুলতানা বাসস’কে জানান, ঘটনার দিন বিকেলে পলাশের ব্যবহৃত মোবাইলে মায়ের মুঠো ফোনে জানানো হয় আন্দোলনে সংঘর্ষে গুলি লেগে তার ছেলে হাসপাতালে মারা গেছে। পরে শ্বাশুড়ি আমাকে ফোন দিয়ে ঘটনাটি বললে আমি হাসপাতালে গিয়ে স্বামীর লাশ শনাক্ত করি। আমি ডিগ্রি পাস করেছি। সরকার যদি আমাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমার জন্য খুব ভাল হয়।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরিফা হক বাসস’কে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদের পরিবারকে পাঁচলাখ টাকা করে দেয়া হবে।