সংকট কাটিয়ে এখন রীতিমতো অলস তারল্যের জোয়ার বইছে ব্যাংকগুলোয়। এক বছর আগেও তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছিল দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তবে মহামারীর প্রাদুর্ভাবে এ পরিস্থিতি বর্তমানে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ ছাড়ের পরও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের বৃত্তে বন্দি। সরকারও এখন ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে কম। বিপরীতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ ও রেমিট্যান্সের উচ্চপ্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোয় অলস অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। অতিরিক্ত এ তারল্যের কারণে ব্যাংকের ঝুঁকি কমলেও তা অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনে না। এর কারণে ছোট ব্যাংকগুলো সুফল পেলেও তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বড় ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগ। দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেয় ২০১৭ সালের শুরুতে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বেশি সুদ দিয়ে এক ব্যাংকের আমানত অন্য ব্যাংক বাগিয়ে নেয়ায় অনেক ব্যাংকের মধ্যে বিরোধও দেখা দেয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি বিপরীত। বেশি সুদের আমানত ছেড়ে দিয়ে ব্যাংকগুলোয় এখন কস্ট অব ফান্ড কমানোর প্রতিযোগিতা চলছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করলেও কোনো কোনো ব্যাংক তা ৩ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে এনেছে। তার পরও বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্যের পাহাড় জমেছে।
চলতি বছরের আগস্ট শেষে দেশের সাধারণ ধারার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকায়। একই সময়ে ইসলামী ধারার বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ১৫ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য জমা হয়েছে। অথচ ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ ধারার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ছিল মাত্র ১৬ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। আর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য ৪ হাজায় ৬৬৫ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। সিংহভাগ বেসরকারি ব্যাংক এতদিন করপোরেট খাতে বড় ঋণ বিতরণেই আগ্রহী ছিল বেশি। এ কারণে ব্যাংকগুলোর জনবল কাঠামো ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বিকশিত হয়েছে মূলত করপোরেট ঋণকে কেন্দ্র করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি এখন বড় করপোরেট ঋণেও বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে ব্যাংক কর্মকর্তারাও এখন করপোরেট ঋণ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। আবার এসএমই খাতে ঋণ দিতেও ভয় পাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে রিটেইল খাতে ভালো বিনিয়োগ আছে এমন ব্যাংকগুলোই কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কয়েক বছর ধরেই ক্রেডিট কার্ডসহ রিটেইল ব্যাংকিংকে গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মাসরুর আরেফিন বলেন, এ মুহূর্তে সিটি ব্যাংকের এডি রেশিও ৭৯ শতাংশ। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা করপোরেট খাতে ঋণ দিচ্ছি না। বড় শিল্পের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ শেষ করেছি। এখন আমরা এসএমই, রিটেইল ও ক্রেডিট কার্ডে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য সিটি ব্যাংকের করপোরেট ঋণ ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা। ব্যক্তিগত ঋণকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা রিটেইল ব্যাংকিং সম্প্রসারিত করছি। এজন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ন্যানো লোনের মতো ব্যতিক্রমী ঋণ প্রডাক্টও চালু করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে আগস্টের শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। গত দুই মাসে এ অলস অর্থের পরিমাণ আরো বেড়েছে। আগে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করত সরকারি-বিল বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বিল-বন্ডের সুদহার নেমে এসেছে প্রায় ৩ শতাংশে। চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহারও নেমেছে ১ শতাংশে। এ অবস্থায় সরকারি-বেসরকারি বেশির ভাগ ব্যাংকেরই ট্রেজারি ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে এসেছে।
৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি সরকারি এসব বিলের সুদহার নামিয়ে এনেছে এক-চতুর্থাংশে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ। অক্টোবরে তা নেমেছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশে। জানুয়ারিতে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা অক্টোবরে ১ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে আসে। একইভাবে জানুয়ারিতে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তা নেমে আসে ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশে।
ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার কমেছে বন্ডেরও। জানুয়ারিতে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদহার ছিল ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ অক্টোবরে তা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে ইল্ড বা সুদহার কমেছে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডেরও। ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য বিনিয়োগের অন্যতম বাজার কলমানিতেও সুদহার ১ শতাংশে নেমেছে। অথচ ফেব্রুয়ারিতে কলমানি বাজারে গড় সুদহার ছিল ৫ শতাংশেরও বেশি। বেসরকারি খাতে ঋণচাহিদা কমার পাশাপাশি সরকারও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া কমিয়ে দেয়ার কারণেই অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে বলে জানালেন ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে এ মুহূর্তে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে গ্রাহকরা ৭-৮ শতাংশ সুদেও ঋণ দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। গ্রাহক ধরে রাখতে অনেক ব্যাংক তাদের দাবি মেনেও নিচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোর তেমন কোনো নতুন বিনিয়োগ নেই। এক ব্যাংকের ঋণ অন্য ব্যাংক টেনে নিচ্ছে। সরকার নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। এ কারণে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। ঋণের চাহিদা তৈরি না হলে ব্যাংক খাতের অতিরিক্ত তারল্য দিন দিন বাড়তেই থাকবে। অলস তারল্য অর্থনীতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
যেকোনো ব্যাংকের আয়ের বড় একটি উৎস হলো বিতরণকৃত ঋণের সুদ। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ঋণের সুদ থেকে কোনো আয় নেই। উল্টো সুদ খাতে গত বছর ৪০৫ কোটি ও ২০১৮ সালে ৬২০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে ব্যাংকটি। এ অবস্থায় ব্যাংকটির আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া আমানত, কলমানি বাজার ও সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ। এ খাত থেকে ২০১৯ সালে ৪ হাজার ১০৩ কোটি এবং ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা আয় করে ব্যাংকটি। ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন তারল্য সংকট গত তিন বছরে সোনালী ব্যাংককে করে তুলেছিল মুদ্রাবাজারের অন্যতম ত্রাতা। কিন্তু মহামারীসৃষ্ট বিশৃঙ্খল অর্থনীতি পরিস্থিতিকে উল্টে দিয়েছে। ব্যাংকটির ট্রেজারি বিভাগ বর্তমানে অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের হাতে বর্তমানে আমানত আছে ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এ আমানত থেকে ৬২ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি। ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) ৫২ শতাংশ। উদ্বৃত্ত আমানতের বড় অংশ সরকারি বিভিন্ন বিল-বন্ড ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি। তার পরও ব্যাংকটির হাতে ৫ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যে আমানত থেকে কোনো আয় নেই সোনালী ব্যাংকের।
পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে মুদ্রাবাজারের অতিরিক্ত তারল্যকে কাজে লাগানো দরকার বলে মনে করছেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান। তিনি বলেন, দেশের পুঁজিবাজারকে ভালো করার এটিই উৎকৃষ্ট সময়। ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য বিপুল তারল্য রয়েছে। এ মুহূর্তে ব্যাংক দিতে চাইলেও বড় করপোরেটগুলো ঋণ নিতে চাইবে না। নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। এ কারণে কলমানি বাজারেও টাকার চাহিদা নেই। পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় নেতৃত্বের পরিবর্তন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়িয়েছে। এখন মুদ্রাবাজারের অতিরিক্ত তারল্যের একটি অংশ পুঁজিবাজারে গেলে বাজার শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে। সোনালী ব্যাংকের মতোই অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুচিন্তায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য তিনটি বড় ব্যাংক। আগে জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আয়ের বড় অংশ আসত ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা থেকে। মুদ্রাবাজারে অলস তারল্যের জোয়ার এ তিন ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগকেও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। তথ্যমতে, আগস্ট শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৫৩ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা, যা গত দুই মাসে আরো বড় হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি ব্যাংকগুলো গণহারে গ্রাহকদের আমানতের সুদহার কমিয়ে এনেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চাইলেই তা করতে পারছে না। আবার আমানত গ্রহণ বন্ধ করাও সম্ভব নয়। কলমানি বাজারে চাহিদা না থাকায় অতিরিক্ত তারল্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানি খাত ঘুরে না দাঁড়ানোয় প্রতিটি ব্যাংকের হাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা জমা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রেজারি বিভাগকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচানো কঠিন।