রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৪ অপরাহ্ন

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গানের গীতিকার সুরকার বাউল কামাল পাশা

আল-হেলাল
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০২০

“ঢাকার বুকে গুলি কেন ? নুরুল আমিন জবাব চাই
ওসে উর্দ্দূ প্রেমে মন মজাইয়া,মারলো কতো শহীদ ভাই।
ওসে উর্দ্দূ প্রেমে মন মজাইলো,করলো কত রং বড়াই।।

শেখ মুজিব কারাগারে,আন্দোলন কেউ নাহি ছাড়ে
সত্যাগ্রহে এক কাতারে,সামনে আছেন সামাদ ভাই।।

ওয়ান ফৌরটি ফৌর জারী করলো,নির্র্বিচারে ছাত্র মারলো
কত মায়ের বুক খালি হইলো,সে কথাতো ভুলি নাই।।

সালাম বরকত রফিক জব্বার,হলেন শহীদ বাংলাভাষার
একটাই দাবী কামাল পাশার,রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ”।।
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দোলাহর পতনের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ায় বৃটিশ বেনিয়ারা ১৯০ বছরের মতো বাঙ্গালী জাতিকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রেখেছিল। বৃটিশদের বিতাড়িত করে ভারতবর্ষকে শত্রুমুক্ত করতে এইদেশে ফরায়েজী আন্দোলন,তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা,সিপাহী বিদ্রোহ ও ফকির বিদ্রোহসহ নানা আন্দোলন হয়েছিল। সবচেয়ে বড় আন্দোলনটির নাম ছিল ফকির বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন ফকির মজনু শাহ মাস্তানা ও ভবানী পাটক। দেশের আউল বাউল ফকিরদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে এই আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন তারা। দীর্ঘ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হলেও বাঙ্গালী জাতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে আরো বেশী অধিকার বঞ্চিত থাকে এবং নির্যাতিত ও বঞ্চনা বৈষম্যের স্বীকার হয়। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এ জাতিকে মুক্তির অগ্নিমন্ত্রে যিনি সর্বপ্রথম উজ্জীবিত করেন তিনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালী,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কিন্তু তিনি একদিনে সৃষ্টি হননি। তার রাজনৈতিক উত্থানের একটি ইতিহাস আছে। উত্থান বিকাশ পতন আর পূনরুত্থানের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে ছাত্রনেতা থেকে জননেতা আর জননেতা থেকে জাতির পিতায় পরিণত হয়েছেন তিনি। দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা যেমন তার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন যুগিয়েছে তেমনি তাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন এদেশের সংগীত সাধকরা। চলমান মুজিববর্ষে এসব সংগীত সাধকদের নিয়ে যেমন অনুসন্ধান চলছে তেমনি চলছে গবেষক বিশ্লেষকদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। গবেষকদের মধ্যে সাংবাদিক সুমন কুমার দাশ ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় তুলে ধরেছেন,“বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম লেখা গান ও শাহ আব্দুল করিম। গবেষক রঞ্জনা বিশ^াস ১৬ অক্টোবর ২০২০ইং সমকাল পত্রিকায় “বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান শিরোনামে” লেখায় দাবী করলেন শাহ আব্দুল করিম নন গোপালগঞ্জের সংগীত সাধক শেখ রোকন উদ্দিন সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংগীত রচনা করেছেন। কিন্তু বাস্তব সত্যটা হচ্ছে,এ দুজনের অগ্রজ মরমী সাধক সুনামগঞ্জের ৫ম রতœ বাউলের মধ্যমনি গানের স¤্রাট বাউল কামাল পাশাই (কামাল উদ্দিন) হচ্ছেন সারাদেশের মধ্যে একমাত্র অন্যতম বাউল শিল্পী যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচনা ও পরিবেশন করেছেন। উপরোক্ত গানটিই হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক দেশাত্ববোধক গান। যে গানের মুখপদে আক্রমন করা হয়েছে তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে। আর প্রথম অন্তরায় ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে “শেখ মুজিব কারাগারে” বলে। এবং সাক্ষী করা হয়েছে ঐ সময়ের ভাষা সংগ্রামী জীবন্ত আরেক কিংবদন্তী ভাটি বাংলার সিংহপুরুষ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ সালে সাফল্যের সাথে এন্ট্রেন্স (এসএসসি) পাস করেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাশে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয় তার। বঙ্গবন্ধু এই বছরেই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে কুষ্ঠিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদান করে গুরুত্¦পূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কলকাতাস্থ ফরিদপুরবাসীদের একটি সংগঠন ‘ফরিদপুরস ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন’ এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরোধ তৎপরতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়াারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তান এর জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ জানান। খাজা নাজিমউদ্দিনের বক্তব্যে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন। ২ মার্চ বাংলা ভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবক্রমে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধু সহকর্মীদের সাথে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় গ্রেফতার হন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারে সারাদেশে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে বঙ্গবন্ধুসহ গ্রেফতারকৃত ছাত্র নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু ১৫ মার্চ মুক্তি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভের পর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র-জনতার সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় বঙ্গবন্ধু সভাপতিত্ব করেন। সভায় পুলিশ হামলা চালায়। পুলিশি হামলার প্রতিবাদে সভা থেকে বঙ্গবন্ধু ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। ১১ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানান। কর্মচারীদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে তাকে জরিমানা করে। তিনি এ অন্যায় নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। ১৯ এপ্রিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার কারণে গ্রেপ্তার হন। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং জেলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু এ দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন। জেল থেকে বেরিয়েই দেশে বিরাজমান প্রকট খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেপ্তার হন ও পরে মুক্তি লাভ করেন। ১১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভায় নুরুল আমিনের পদত্যাগ দাবি করেন। পাকিস্তান এর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেবার জন্য ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবারে তাকে প্রায় দু বছর পাঁচ মাস জেলে আটক রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমউদ্দিন ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তান এর রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। এর প্রতিবাদে বন্দি থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দাবিতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে।
বঙ্গবন্ধু জেলখানায় আটক থাকলেও এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার ভুরাখালি গ্রাম নিবাসী আব্দুস সামাদ আজাদ,দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানীগাঁও জয়কলস নিবাসী সোনাওর আলী,তাহিরপুর থানার বড়দল গ্রামের মেডিকেল ছাত্র ডা: হারিস উদ্দিনসহ আরো অনেকে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একটানা ১৩ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেলখানা থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে তাকে ঢাকা জেলখানা থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ডিসেম্বর মাসে তিনি পিকিং-এ বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার কৃতিসন্তান প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড.আখলাকুর রহমানের পত্র পেয়ে সুনামগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ মহকুমা শাখা গঠন করা হয়। এর আহবায়ক নির্বাচিত হন সুনামগঞ্জের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক আব্দুল হাই হাছন পছন্দ। উক্ত আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য দিরাই থানার ভাটিপাড়া নিবাসী আবুল হাশিম চৌধুরী দিরাই থানা সফর করে সেখানেও একটি কমিটি গঠন করেন। দিরাই থানা কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত করেন বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন) কে। জনাব কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দিরাই থানা কমিটিতে আরো যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন আব্দুন নূর মাস্টার ভরারগাঁও,মৌলানা ছাদিকুর রহমান হাতিয়া, চাতকের চেচান নিবাসী মতছিন মিয়াসহ আরো অনেকে। কিন্তু বাউল কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন ভাষা সংগ্রাম পরিষদ দিরাই থানা কমিটি থানা সদরে কার্যত কোন সভা করতে পারেনি পুলিশের দমন পীড়নের ভয়ে। পরে তারা ২৭ ফেব্রুয়ারি দিরাই থানা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী রাজানগর কেপিসি হাইস্কুল মাঠে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে একটি প্রতিবাদ সভা করেন। ঐ সভাতে বাউল কামাল পাশা নিজেই সভাপতিত্ব করেন। এবং তাৎক্ষনিকভাবে রচনা করে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ৩টি গান পরিবেশন করেন। এর মধ্যে প্রথমোক্ত গানটিতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি উল্লেখ করেন।
এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে,৫২র ভাষা আন্দোলনের পূর্বেই বাউল কামাল পাশা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিভ্রমনকারী একজন ভ্রাম্যমান বাউল শিল্পী। রাজধানী ঢাকায়,কেরানীগঞ্জ বা মানিকগঞ্জ অঞ্চলে কোন বাউল গানের প্রোগ্রামে আসা যাওয়ার পথে তিনি সুনামগঞ্জের ছাত্রদের ম্যাচে উঠতেন। “আমরা সুনামগঞ্জী ছাত্ররা তাকে ম্যাচে মেহমান হিসেবে সম্মানের সাথে রাখতাম এবং অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করতাম” এমন কথা জীবদ্ধশায় স্বীকার করে গেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। তাই সামাদ আজাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতেই শেখ মুজিবের নামটি গানে উল্লেখ করেছেন কামাল পাশা একথা নিসেন্দেহে দাবী করা যায়।
গোপালগঞ্জের গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস প্রদত্ত,
“ধান কাটিতে গেলামরে ভাই খুলনা জেলার পরে
ওসে গোডাউনে ধান উঠাইলো কন্ট্রোলের ব্যাপারে।
আইলাম সবে বাড়ি ফিইর‌্যা মহাজনের দেনায় পইড়্যারে।।
ওরে ঘরবাড়ি সব দিলাম ছাইর‌্যা,রাস্তায় রই শুইয়ারে।।
চাষী মরছি না খাইয়্যা।।
শেখ মুজিবর বলেছিল ছেড়ে দেগো ধান
ওসে আমার দেশের দাওয়াল ভাইরা ভিক্ষা দাওরে প্রাণ।
জালিম সরকার ধান না দিয়া মুজিব ভাইরে নিল ধইর‌্যা।
তারে ৩টি বছর জেলে রাখলো,বিচার না কইর‌্যা।।
চাষী মরছি না খাইয়্যা ”।।
এখানে গানটির বিশ্লেষণ করলে পরিস্কার অনুধাবন করা যায় যে, ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। ২ বছর ৪ মাস ১৩দিন একাধারে তিনি জেলে ছিলেন। গানটিতে ৩টি বছর জেলে রাখলো বিচার না কইর‌্যা ” বলতে জেলখানার ঐ দিনগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে গানটিও রচনা করা হয়েছে ৩ বছর পরে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির পর । সুতরাং এটি ১৯৫১ সালে নয় বরং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালেই রচনা বলে আমি চ্যালেঞ্জ করছি। তাই ৫৪ সালের রচিত গানটিকে সামনে রেখে কেউ যদি দাবী করেন এটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত প্রথম গান তাহলে তারা ভূল করবেন। কারণ এর আগে ৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজানগর হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক সভামঞ্চে কামাল পাশা প্রকাশ্য দিবালোকে শেখ মুজিব নামটি উল্লেখ করে তার রচিত গানটি গেয়েছেন।
অন্যদিকে সাংবাদিক সুমন কুমার দাশের মতে,
পূর্ণচন্দ্র উজ্জল ধরা,চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা
জনগনের নয়নতারা শেখ মুজিবুর রহমান
জাগো জাগরে মজুর কৃষাণ।।
৫৪ সালের রচিত এই গানটির প্রকৃত গীতিকার শাহ আব্দুল করিম কিনা ? সেটা অবশ্য আমি এখনও জানতে পারিনি। কারণ জনগনের নয়নতারা শব্দ দিয়ে বাউল কামাল পাশার রচিত গান ছিল বলে আমাকে বাউল কামাল পাশার শীষ্য মজনু পাশা জানালেও আমি সেই গানগুলো এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। তবে সুমন কুমার দাশের সংগৃহিত এই গানটির গীতিকার যদি বাউল কামাল পাশা না হয়ে শাহ আব্দুল করিমও হয়ে থাকেন সেটা অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। যেহেতু কামাল-করিম দুটি নামই সমানভাবে উল্লেখ করতেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি। এখনও এই দুই জনের নাম হৃদয়ের মনিকোটায় লালন করে চলেছেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি সাবেক এমপি আলহাজ্ব মতিউর রহমান।
১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর দুর্নীতি দমন মন্ত্রী থাকাবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম সুনামগঞ্জ সরকারী সফর করেছেন এটা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। শুধু তাই নয় ঐসময় কেন্দ্রে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২ বার সিলেট শুভাগমন করেছেন। সোহরাওয়ার্দী,মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের একাধিক জনসভায় বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম গান গেয়েছেন এটা দিবালোকের মতো সত্য। কিন্তু শুধু শাহ আব্দুল করিমই নন বঙ্গবন্ধুর একাধিক সভামঞ্চে গান গেয়েছেন শাহ আব্দুল করিমের অগ্রজ লোকশিল্পী বাউল কামাল পাশা। দিরাই,ছাতক ও সুনামগঞ্জ থেকে ধর্মপাশা পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে ৮ বার নির্বাচনী,সাংগঠনিক ও সরকারী সফরে আসেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিবারই কোননা কোন সভায় সংগীত পরিবেশন করেছেন বাউল কামাল পাশা ও তার শীষ্যরা। ছাতকে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহও গান গেয়েছেন। ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পরও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাউল কামাল পাশার কন্ঠসাধনা অব্যাহত ছিল।
তাই সাংবাদিক সুমন কুমার দাশের মতে,পূর্ণচন্দ্র উজ্জল ধরা,চৌদিকে নক্ষত্র ঘেরা/জনগনের নয়নতারা শেখ মুজিবুর রহমান/জাগো জাগরে মজুর কৃষাণ।। গানটি যদি ১৯৫৪ সালে রচিত ও পরিবেশিত কোন গান হয়ে থাকে তাহলে এই গানটি অবশ্যই ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী গান। এবং বাউল কামাল পাশা পরিবেশিত “ঢাকার বুকে গুলি কেন? নুরুল আমিন জবাব চাই” এটি যে পূর্বের গান তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৪ ইং বিটিভিতে অচিন মানুষ অনুষ্ঠানে ভাষা আন্দোলনে বাউল কামাল ভাষার অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বিটিভির এই আলোচনানুষ্টানে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়মন জাকারিয়া ও প্রযোজক আবু ইসহাক হোসেন। এর আগে ৭/২/২০১৪ইং রোজ শুক্রবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের রামপুরা প্রধান কেন্দ্রের ২নং স্টুডিওতে অনুষ্ঠানটির জন্য বাউল কামাল পাশা রচিত উপরোক্ত গানটি আমার কন্ঠ নিয়ে রেকর্ড করা হয়। রেকর্ডিং শুরু হওয়ার আগেই গানটির কম্পোজ করা প্রিন্ট কপি হস্তান্তর করি গবেষক ড.সায়মন জাকারিয়া,প্রযোজক আবু ইসহাক হোসেন ও বাউল আরিফ দেওয়ানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। আমি আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনা ঐ অনুষ্ঠানে সায়মন জাকারিয়া যে বাউল কামাল পাশার গানের কথা আলোচনায় উপস্থাপন করলেন সে তিনিই পরবর্তীতে তার প্রকাশিত বইয়ে বাউল কামাল পাশার ব্যাপারে কিছুই লিখলেননা।
তবে এর আগে ২১ ডিসেম্বর শনিবার ২০১৩ ইং বিকাল ১টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভিতে) এবং দ্বিতীয় দফায় ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার রাত সাড়ে ৭ টায় বিটিভি ওয়ার্ল্ডে রণাঙ্গনে একতারা অনুষ্ঠানে এবং মুজিববর্ষ উপলক্ষে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ইং রোজ মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভিতে) এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ডে রণাঙ্গনে একতারা অনুষ্ঠানে বাউল কামাল পাশার জীবন দর্শনসহ ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বাউল শিল্পীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ও কামালগীতি পরিবেশনা যথারীতি সম্প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানের সহযোগী প্রযোজক কামাল উদ্দিন আহাম্মদ এর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঐ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ৭১ এর রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ গীতিকার মানিকগঞ্জের সাইদুর রহমান বয়াতি,কুষ্ঠিয়ার মহেন শাহ সাইজী, সুনামগঞ্জের যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এন.এম মাহমুদুর রসুল ও কামালগীতি গবেষক আমি আল-হেলাল। অনুষ্ঠানে কামালগীতি পরিবেশন করেন টেলিভিশন শিল্পী আবুবক্কর সিদ্দিক,বাউল আমজাদ পাশা,বাউল শফিকুন নূর। তাদের সাক্ষাৎকার ও সংগীতানুষ্টানটি গ্রহন করেন রনাঙ্গণের একতারা অনুষ্ঠানের প্রযোজক পরিচালক মোঃ আবু ইসহাক হোসেন। অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত গান “মুজিব বাইয়া যাওরে”সহ ৩টি গান পরিবেশন করা হয়। আলোচনায় আসে আরো একাধিক গানের কথা। যে গানগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাউল কামাল পাশার উপরোক্ত গানটি বিশেষভাবে স্থান পায় ও গুরুত্ব বহন করে।
এছাড়া ২০১১ ইং থেকে ২০২০ ইং পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সুনামগঞ্জের বর্তমান জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল আহাদ,সাবেক জেলা প্রশাসক মোঃ সাবিরুল ইসলাম,শেখ রফিকুল ইসলাম ও ইয়ামিন চৌধুরী এবং জেলা কালচারাল অফিসারসহ অনেক কর্মকর্তার প্রেরিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাউল কামাল পাশার প্রথম রচিত গানটির কথা বিশেষভাবে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হচ্ছে গবেষক সুমন কুমার দাশ ও রঞ্জনা বিশ্বাস এই দুজনকে,তাদের আলোচ্য দুটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার অনেক আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত বাউল কামাল পাশার গানগুলো আমি ইমেইল করে পাটিয়েছিলাম। তারা আমার মেইলগুলো চেক করে আমাকে প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন। আমার বিশ্বাস তারা যদি ইমেইলগুলো ভালভাবে চেক করে প্রেরিত গানগুলোর মধ্যে একটু চোখ ভূলাতেন এবং নিজেদের অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করতেন তাহলে আসল সত্যটি খুঁজে পেতেন। আর সেই সত্যটিই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গানের রচয়িতা সুরস্রষ্টা বাউল কামাল পাশা।
গোপালগঞ্জে জন্ম নেয়া গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন,৫৬ সালের আগে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিমের আদৌ পরিচিতি ছিল কিনা ? এছাড়া গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম তাই স্থানীয়ভাবে গোপালগঞ্জের শেখ রোকন উদ্দিনই সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখেছেন। এটা তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ধারনা হতে পারে। কিন্তু এটা কখনও যুক্তি হতে পারেনা। কারণ সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ মহাভারত। ভারতবর্ষে লক্ষ কোটি বাংলাভাষাভাষি জনগোষ্ঠী ছিলেন আছেন। স্থানীয়ভাবে কেউই মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করতে পারেননি। মহাগ্রন্থ মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেছেন সুনামগঞ্জের লাউড়ের কবি সঞ্জয়। তাই সুনামগঞ্জের লোককবি যদি সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করতে পারেন তাহলে সুনামগঞ্জের লোককবি কামাল পাশা ও শাহ আব্দুল করিম গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সর্বপ্রথম গান লিখতে পারবেননা এটা ভাবা ঠিক নয়। আমি তার এ যুক্তিকে খন্ডন করে বলবো, ফরিদপুরের পল্লীকবি জসীম উদ্দিন,বাউল শিল্পী হাজেরা বিবি,টাঙ্গাইলের লোকমান হোসেন ফকির,গোপালগঞ্জের ফটিক গোঁসাই,শের আলী ফকির ও কবি কাশেম রেজাসহ আরো অনেক বাউল কবি সাধকদের জন্ম হয়েছে। কিন্তু কয়জন ৫৪ সালের আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি গান বা কবিতা রচনা করেছেন তাকি তিনি আদৌ দেখাতে পারবেন? কিন্তু ঐ সময়ে অর্থাৎ ৫৪ সালের আগে থেকেই বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ও ঢাকা জেলা সদর ছাড়াও বিভিন্ন মহকুমা সদরে বাউল গান গেয়ে বেড়িয়েছেন বাউল কামাল পাশা।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে বাউল কামাল পাশার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের আদৌ পূর্ব পরিচিতি ছিল কিনা? এজন্য আমি আরেকটি তথ্য সকলের সামনে উপস্থাপন করতে চাই, আর তা হচ্ছে,দিরাই থানার সর্বপ্রথম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন ভাটিপাড়ার বিখ্যাত জমিদার খান বাহাদুর গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। যার জন্ম ১৮৮২ সালে ভাটিপাড়ায়। মৃত্যু ১৯৬৭ সালের ১৬ অক্টোবর সিলেটের দরগা মহল্লায়। সম্পাদক : ফারুকুর রহমান চৌধুরীর উদ্যোগে নভেম্বর ২০১৯ইং,উড়াল প্রকাশ,সুনামগঞ্জ হতে ত্রৈমাসিক দাফনা নামে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। এর ৯ পৃষ্টায় উল্লেখ করা হয়,১৯৩৭ সালে আসাম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচিত এমপি (পরবর্তীতে আসাম পার্লামেন্টের স্পীকার) খান বাহাদুর গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর একান্ত সচিব ছিলেন (বাউল কামাল পাশার পিতা) মরমী কবি আজিম উদ্দিন। যাকে নিজ খরচে বিলেতে নিয়ে যান খান বাহাদুর গোলাম মোস্তফা চৌধুরী। কলকাতার শিলং শহরে অবস্থানকালে ১৯৪৭ইং দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত আসামের এমপি খান বাহাদুর গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ও পিতা মরমী কবি আজিম উদ্দিনের সাথে শিলং শহরে অবস্থান করেন বাউল কামাল পাশা। এই সময় তিনি ভ্রাম্যমাণ বাউল শিল্পী হিসেবে কলকাতা থেকে করাচী পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। এবং শিলং থেকেই তার সাংস্কৃতিক জীবনের ব্যপ্তি ঘটে। তখনই কলকাতা গ্রামোফোন কোম্পানীর তালিকাভূক্ত গীতিকার হন কামাল পাশা। খান বাহাদুর গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর প্রিয়ভাজন হওয়ায় তৎকালীন সময়ের রাজনীতিবিদ জওহরলাল নেহেরু,নেতাজী সুভাস বসু, শেরে বাংলা একেএম ফজলুল হক,মাওলানা ভাসানী,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ ভারতবর্ষের নামকরা রাজনীতিবিদদের সাথে তাঁর পরিচয় লাভের সুযোগ হয়। তাই বাউল কামাল পাশা যদি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে চেনেন জানেন তাহলে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে চিনবেন না বা জানবেননা এটা কখনও হতে পারেনা। এ ব্যাপারে যদি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে তাহলে এই বিষয়ে তারা গবেষণা ও অনুসন্ধান করতে পারেন। আমি আবারও চ্যালেঞ্জ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে নিয়ে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সংগীত রচয়িতা ও সুরকার শিল্পীর নাম বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন)। যিনি ১৯০১ইং সনের ৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ভাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। মৃত্যুবরন করেন ১৯৮৫ সালের ৬ই মে নিজ বাড়িতে। নিচে সকলের সদয় অবগতির জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাউল কামাল পাশা রচিত ও পরিবেশিত গানগুলির শিরোনাম তুলে ধরলাম। যেগানগুলোতে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি স্বাধীনতা স্বায়ত্বশাসন ও গণতন্ত্রের প্রতিক নৌকার কথা উপস্থাপন করেছেন। মাৎস্যন্যায় এর রুপকে বলেছেন মানুষের মুক্তির কথা।
১ (মাতৃভাষার গান) যারা কেড়ে নিতে চায় মায়ের ভাষা নিদয়া নিষ্ঠুর পাষাণ
২ (মাতৃভাষার গান) ঢাকার বুকে গুলি কেন ? নুরুল আমিন জবাব চাই
৩ (যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের গান) দেশের যত নওজোয়ান হও তোমরা আগুয়ান
৪ (আঞ্চলিক) দেশে আইল নতুন পানি,গুছে গেল পেরেশানী,মাছের বাড়লো আমদানী দু:খ নাইরে আর
৫ (দেশাত্ত্ববোধক) নৌকা বাইয়া যাওরে বাংলার জনগন যুক্তফ্রন্টের সোনার নাও ভাসাইলাম এখন
৬ (দেশাত্ত্ববোধক) সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা আমার পরিল দুর্দিনে সয়না প্রাণে ॥
৭ (দেশাত্ত্ববোধক) অগ্নিকুন্ড নর হত্যা চালাইলো পাঞ্জাবী এসে/স্বাধীন বাংলা দেশে আমার সোনার
৮ (দেশাত্ত্ববোধক) বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যেমন ভাই নিশার স্বপন স্বপ্নের মতোন,২৩ বছরের জ্বালাপুড়া
৯ (দেশাত্ববোধক) নৌকা আগে আগে চলেরে সেই নৌকাটা শেখ মুজিবের,ও নাও দেখতে ভাল
১০ (দেশাত্ত্ববোধক) রক্ত দিয়া স্বাধীন করলাম স্বাধীনতা পাইলাম কই,এখনও গল্লা চলে আমরা পরাধীনে রই
১১ (দেশাত্ত্ববোধক) নৌকা বাইয়া যাওরে বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর সোনার নাও ভাসাইলাম এখন॥
১২ (শহীদ আসাদ স্মরণে গান) আমার পূর্ব পাকিস্তান,হইতেছে স্মশান/আর কতকাল থাকবে ঘরে বসেরে
১৩ (আঞ্চলিক) ও পচা জারমুনি ৬ দফার বাতাসে তুমি ঠিকবায়নি/ধান খাইলে পাট খাইলে হইয়া তুই
১৪ (আঞ্চলিক) হাজার হাজার নেতার জন্ম বাংলাদেশের ঘরে ঘরে/ভাবলে মাথা ঘুরেরে মন ভাবলে মাথা
১৫ (আঞ্চলিক) আওয়ামীলীগ নাম নিয়া ছয় দফা এগিয়া/জাগো জাগো বাঙ্গালী ভাই মুজিব বাতায়া।।
১৬ (আঞ্চলিক) মুজিব বাইয়া যাওরে তোমার ছয় দফারী নাও/নিপীড়িত দেশের মধ্যে জনগনের নাও
১৭ (আঞ্চলিক) মুজিব বাইয়া যাওরে/ নির্যাতিত দেশের মধ্যে জনগনের নাও মুজিব বাইয়া যাওরে।।
১৮ (দেশাত্ত্ববোধক) দিন গেলরে কৃষক মজুর ভাই করলে না তুই দেশীদের ব্যবস্থা/তেইশ বছর হইল
১৯ (দেশাত্ত্ববোধক) ভাত নাই বাঙ্গালীর পেটে কইতে মোর কলিজা ফাটে/কান্দে লোকে রাস্তাঘাটে
২০ (দেশাত্ত্ববোধক) তোমরা অস্ত্র ধররে ওরে আমার বীর বাঙ্গালী ভাই/পাঞ্জাবী আসিলো দেশে বাঁচার
২১ (পল্লীগীতি) পূর্বে ছিল এই বাংলা আইয়্যুবের অধীন/বঙ্গবন্ধু আনিয়াছেন বাঙ্গালীর স্বাধীন
২২ (দেশাত্ত্ববোধক) বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু নামরে/বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু নাম॥
২৩ (দেশাত্ববোধক গান) আমরা বাংলাদেশের লোকরেও ভাই বাংলাদেশের লোক/বাংলা মায়ের সন্তান
২৪ (দেশাত্ববোধক) বাংলা মায়ের সন্তান আমরা কাঁদে কাঁদ মিলাইয়া চলি/আমরা বীরবাঙ্গালী রে ভাই
২৫ (দেশাত্ববোধক) হায়রে আমার ভাষা আন্দোলন/সালাম জব্বার রফিক ভাইয়ের হইলো মরণরে
২৬ (দেশাত্ববোধক) ভাবি দিবারাতি কি হবে গতি,যে দুর্র্নীতি দেশে দেখা দিলো/ন্যায়নীতি সুবিচার
২৭ (দেশাত্ববোধক) আমি ভেবেছিলাম কোনদিন দেশটা হবে স্বাধীন/চিরশান্তি ভোগ করিবো বসিয়া ঘরে।
২৮ (দেশাত্ববোধক) আমার জন্ম বাংলাদেশে, আমার জন্ম বাংলাদেশে/হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রীষ্টান চলি
২৯ (শহীদ স্মরণে) হে শহীদ ভাইয়েরা,আমরা ভুলবোনা কোনদিন,তোমাদেরী এই আমানত।
৩০ (আঞ্চলিক) জৈষ্টি মাইয়্যা বৃষ্টির জোরে কইয়া পুটি উজান বায়/দারকিনারা দার্জিলিং এ পানসী
৩১ (আঞ্চলিক) শোন দেশের জনগণ (বন্ধুয়াগণ) লাগল মজার নির্বাচন/মাছে মাছে করে কীর্তন, স্বাধীনের
৩২ (১৫ আগস্ট এর শহীদদের স্মরণে) বন্ধু সদায় জলে গাও/প্রেমাগুনে পুড়া অঙ্গ কেনবা জ্বালাও ॥
৩৩ (পদাবলী সুর) বলে বাংলার সব জনতা,বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা/বাংলায় আর কি জন্ম নেবেরে এমনও আদর্শ নেতা
৩৪ (সুনামগঞ্জে জাতির জনকের সংবর্ধনা মঞ্চে) ধন্য নেতা শেখ মুজিবুর বাঙ্গালীর নয়নমনি
৩৫ (জাতির জনকের শানে) ধন্য নেতা মুজিবুর রহমান,বাঙ্গালীর পরান/গুনে শ্রেষ্ট মহান নেতা
৩৬ (ভোটের গান) নৌকা চিহ্নে ভোট করিও দান হিন্দু মুসলমান/আদমকে গন্দম খাওয়াইতে
৩৭ (জাতির জনকের শানে) ধন্যবাদ হে জাতির পিতা বাঙ্গালীর নয়নমনি,ধন্য নেতা তাজ উদ্দিন নজরুল
৩৮ (মুক্তিযুদ্ধের গান) সোনার বাংলা স্মশান করলো দুষ্ঠ পাঞ্জাবী এসে,সোনার বাংলাদেশে,মোদের
৩৯ (আইয়্যুব খানের বিরুদ্ধে) ও পচা জারমুনি,৬ দফার বাতাসে তুমি ঠিকবায়নি,ধান খাইলে পাট খাইলে
৪০ (মুক্তিযুদ্ধের গান) মুজিব একবার আসিয়া,সোনার বাংলা যাও দেখিয়ারে।।
৪১ (দেশাত্ববোধক গান) আরে ও বঙ্গবন্ধু মুজিব ভাই,জয়বাংলা বলিয়া আইছো রঙ্গিন পাল উড়াই।
৪২ (ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু কে উৎসর্গ করে) ভারতমাতা তুমি ইন্দিরা গান্ধী,নমস্কার জানাই বারেবার
৪৩ (শেখ হাসিনা,শেখ কামাল,শেখ জামাল,শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল স্মরণে) ওরে ছাড় নৌকা জয়বাংলা বলিয়া
লেখক : আল-হেলাল,প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ সুনামগঞ্জ ও গীতিকার বাউল বাংলাদেশ বেতার সিলেট।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com