পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;
এশিরিয়া ধুলো আজ ব্যাবিলন ছাই হ’য়ে আছে
(সেইদিন এই মাঠ/জীবনানন্দ দাশ)
কবিতায় জীবনানন্দ দাশ কোন ইতিহাস সচেতনতার কথা বলেছেন, অনেক পাঠকই তা ধরতে পারেননি। বাগদাদ নগরীর জন্মের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল ওই দুই লাইন, তাও এক প্রহেলিকা মনে হতে পারে। তা দূর করতেই আমাদের বাগদাদের ইতিহাস খতিয়ে দেখতে হবে। অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে গোড়াপত্তন করা বাগদাদ নগরী অনন্য স্থাপত্যশৈলীর কারণে তৎকালেই জগদ্বিখ্যাত ছিল। মাত্র দুই দশকের মধ্যেই নগরীটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসে, যা সক্রিয় ছিল হালাকু খাঁর ধ্বংসযজ্ঞের আগ পর্যন্ত। এর মাঝেই পাঁচ শতাধিক বছর তার জৌলুস ছড়িয়েছে বাগদাদ। ওই সময়টা ইসলামের স্বর্ণযুগ হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত। ধর্মাশ্রয়ই কি এ নগরীকে স্বর্ণাক্ষরে খচিত করেছে? ইতিহাসে এ নিয়ে আলোচনা আছে। তবে লক্ষণীয় হলো, সামন্তীয় যুগে পৃথিবীর অনেক নগরায়ণের মতোই রাজধানী বাগদাদের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে একটি বংশের উত্থান-পতনের ইতিহাস। তা হচ্ছে আব্বাসীয় বংশের খিলাফত। যে কারণে আব্বাসীয় বংশের উত্থানের আগে বাগদাদ যেমন রাজধানী ছিল না, পরেও তেমনি থাকেনি। আসলে প্রাচ্যের ইতিহাসের সাম্রাজ্য শাসনে প্রতিটি নতুন বংশের উত্থানের সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে রাজধানী বদলের ইতিহাস। এ রাজধানী বদলের সঙ্গে শুধু যে উচ্চাভিলাষ ও নিতান্ত শৌর্য প্রদর্শন জড়িত, তা নয়; বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক কারণও বিদ্যমান। নগরের ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের সেই ঐতিহাসিক কারণও খতিয়ে দেখতে হবে। বাগদাদের ক্ষেত্রে এর কারণ খুঁজতে হবে পূর্ববর্তী আরব ইতিহাসে।
ইসলামের ইতিহাসের একেবারে শুরুতে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরতে বাধ্য হলেন, সেই সময়ের ছোট নগরী ‘ইয়াসরিব’-এ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘটনাই আরবের পুরনো নগর বাদ দিয়ে ওই প্রাদেশিক নগরীকে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। আজকের দিনে আমরা যাকে চিনি মদিনা বা ‘নবীর শহর’ বলে। একে কেন্দ্র করে মরুপ্রধান মধ্যপ্রাচ্যের বহু বিভক্ত গোত্র এক আরব জাতিতে ঐক্য গড়ে বিশ্বের ইতিহাসই বদলে দিয়েছে। এ মদিনা থেকেই পরবর্তী কয়েকটি ধর্মতান্ত্রিক সরকার পরিচালিত হয়েছে। ‘খলিফায় রাশেদিন’-খ্যাত নবী মুহাম্মদ (সা.) পরবর্তী চার খলিফার তিনজন আবু বকর (রা.), ওমর (রা.) ও ওসমান (রা.) এখান থেকেই সরকার পরিচালনা করেন। কিন্তু পরবর্তী খলিফা হজরত আলী (রা.) হঠাৎ করেই মদিনা ও নিকটবর্তী প্রসিদ্ধ নগরী হিজাজ ত্যাগ করে মেসোপটেমিয়ার কুফা নগরীতে রাজধানী স্থাপন করেন। হজরত আলীর (রা.) মৃত্যুর পর উমাইয়া বংশের প্রথম খলিফা হিসেবে ক্ষমতায় আসেন মুয়াবিয়া। শুরুতেই ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য ইসলামের বড় দুই কেন্দ্র মক্কা-মদিনা থাকতেও অনুগতদের নিয়ে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন দামাস্কাসে। যথারীতি অল্পদিনেই প্রাদেশিক শহর সিরিয়ার দামাস্কাস হয়ে উঠল মহানগরী। উমাইয়া ভাবধারার জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশও হয় সেখানে। কিন্তু এর বড় অসুবিধা হলো তৎকালীন নৌপথনির্ভর বণিকদের কোনোভাবেই তারা আয়ত্তে আনতে পারছিল না। এর কারণ দামাস্কাসে বড় কোনো নদী নেই। ফলে উটের মরুর কাফেলা পথনির্ভর সীমিত বাণিজ্যই ছিল প্রধান ভরসা।
উমাইয়া বংশের শেষ খলিফা মারওয়ান দ্বিতীয়কে উচ্ছেদ করতে খুব বেগ পেতে হয়নি আব্বাসীয়দের। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসেন আব্বাসীয় বংশের প্রথম খলিফা ‘দ্য ব্লাড শেডার’-খ্যাত সাফফাহ। কিন্তু মাত্র চার বছরের মাথায় সাফফাহ মারা গেলে ৭৫৪ সালে ক্ষমতায় আসেন তার ভাই, আব্বাসী বংশের সবচেয়ে উজ্জ্বল খলিফা আবু জাফর আল-মনসুর। পূর্বের অভিজ্ঞতায় তিনিও উমাইয়াদের প্রভাবিত পূর্বতন রাজধানীতে বসে নিষ্কণ্টক রাজ্য চালানোর কথা ভাবতে পারছিলেন না। তাই নতুন শাসকের জন্য অনুগত রাজ্য দরকার হয়ে পড়ল। নতুন রাজধানী করার জন্য জায়গা খুঁজতে শুরু করেন আল-মনসুর। তবে পূর্বের রাজধানীগুলোর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন ও পরিকল্পিত স্থাপত্যের মধ্যে নিহিত আছে বাগদাদের সমৃদ্ধি। তবে ক্ষমতায় আরোহণ ও বাগদাদে রাজধানী স্থাপনের আগে অন্তত দুই জায়গায় প্রসাদ স্থাপন করেছিলেন আল-মনসুর। পূর্ববর্তী খলিফার অনুসরণে হলেও এটা নিতান্তই অপচয় নয়, তারও ছিল কৌশলগত কারণ। সেই ইতিহাস আগে সেরে নেয়া দরকার। আজকের ইরাক ও কুয়েতের বিরাট অংশ এবং সিরিয়ার পূর্ব ও তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার বিস্তীর্ণ উর্বর এলাকা প্রথম যখন মুসলিমরা অধিকার করল, তখন দুই নদীর মিলনমুখে বসরা ও ইউফ্রেটিসের তীরবর্তী কুফা নগরীতে পাহারাদার সৈন্যদল মোতায়েন করা হয়। ক্ষমতারোহণের পর ইউফ্রেটিসের পূর্ব তীরবর্তী প্রাচীন পারস্য নগরী আনবারে নিজ গোত্রের কাছাকাছি হাসিমিয়াহ নামে প্রাসাদ স্থাপন করেন খলিফা সাফফাহ। তার দেখাদেখি অনুজ খলিফা আল-মনসুর একই নামে একটি প্রাসাদ স্থাপন করেন প্রাচীন পারস্য নগরী হেরা ও আরব সৈন্য অধ্যুষিত কুফা নগরীর মাঝামাঝি এলাকায়। ইউফ্রেটিসের আরব অংশখ্যাত এলাকায় এ প্রাসাদ দশম শতক পর্যন্ত টিকে ছিল। তার দ্বিতীয় প্রাসাদ স্থাপন করেন কুফার অদূরে ইবন-হুবায়রা নগরের কাছাকাছি। ইউফ্রেটিসের পূর্বতীরবর্তী এ জায়গা কুফা নগরীর চেয়ে উঁচু। পরে অনুগত দেশে নতুন রাজধানী স্থাপনের প্রয়োজনে তিনি এ এলাকা ত্যাগ করেন। তবে স্মরণ রাখা যেতে পারে, পরবর্তী সময়ে বৃত্তনগরী বাগদাদের বিখ্যাত গেট স্থাপনের মাধ্যমে তিনি এসব অঞ্চল যুক্ত করেছিলেন।
উমাইয়া প্রভাবিত দামাস্কাসে আব্বাসীয় মানোভাবের প্রতিকূলতার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। নদীবন্দর না থাকলেও প্রাচ্য-প্রতীচ্যের বাণিজ্যে বিখ্যাত ‘সিল্করুট’-এর গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এ নগরী। খলিফা মনসুর কেন দামাস্কাসে রাজধানী স্থাপন করলেন না? পূর্ববর্তী শাসকদের অনুসরণ ছাড়াও এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক কারণ আছে। আব্বাসীয়দের অন্যতম সহায় পারস্য রাজ্য থেকে দূরের নগরী দামাস্কাস বিপজ্জনকভাবে গ্রিক সীমান্তঘেঁষা। উমাইয়াদের শাসনামলে প্রতিকূল এলাকা হিসেবে খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে আক্রমণের পুরনো বিবাদ ক্রমেই চাগাড় দিয়ে উঠছিল। ফলে বাইজেনটাইনদের মতো পশ্চিমে অগ্রসর না হয়ে পূর্বদিকে মধ্য এশিয়ার দিকে এগোনো তার জন্য অনেক বেশি যৌক্তিক ছিল। যে কারণে আরব বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ ট্রাইগিসের দিকেই অগ্রসর হয়েছেন মনসুর। কৌশলগত কারণে ওই এলাকা থেকে ইউফ্রেতিসের প্রবাহ থেকেও পানি ও কয়েকটি নালা পাওয়া যেত, যা বাণিজ্যের লক্ষ্মীর সঙ্গে চাষাবাদেও সহায়ক হয়।
নতুন রাজধানী স্থাপনের জন্য জারজারাইয়া থেকে মসুল নগরী পর্যন্ত টাইগ্রিসের তীর ধরে অনেকবার ধীরে নৌভ্রমণ করেন মনসুর। স্থান হিসেবে প্রথমে মসুলে নিচু ভূমি বারিমমা এলাকাকে পছন্দ করেন। জাবাল হামরিন পাহাড় ভেদ করে যাওয়া ট্রাইগ্রিস তীরবর্তী এ এলাকা পূর্ববর্তী কুফা নগরীর অভিজ্ঞতায় বাতিল করে দেন। শেষ পর্যন্ত টাইগ্রিসের পশ্চিম তীরবর্তী ও শক্তিশালী সারাত নালা অধ্যুষিত স্থানকেই চূড়ান্ত করেন খলিফা।
জ্যামিতিবিদ্যায় পারদর্শী খলিফা আল-মনসুর জ্যামিতির জনক গ্রিক ইউক্লিডের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বৃত্তাকার নগরপত্তন করেন। রাজ জ্যোতিষীর নির্ধারিত ৭৬২ সালের ৩০ জুলাই, নামাজ আদায় ও পাথর স্থাপনের মাধ্যমে বাগদাদ নির্মাণ উদ্বোধন করেন তিনি। পাঁচ বছর ধরে চলা নির্মাণকাজ ৭৬৭ সালে সম্পন্ন হয়। মাঝে অবশ্য হিজাজ নগরে শিয়াদের অভ্যুত্থান চেষ্টার কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধও ছিল। মুসলিম লিপিকার ইয়াকুবির মতে, এক লাখ শ্রমিক প্রয়োজন হয়েছিল এর নির্মাণ শেষ করতে। প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্বের জনবহুল নগরে পরিণত হয় বাগদাদ। তখন এর জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
ফার্সি শব্দ ‘বাগ’ মানে ‘বাগান’, আর ‘দাদ’ অর্থ ‘প্রদত্ত’ বা ‘উপহার’। অন্য এক অর্থ অনুসারে ‘বাগ’ বলতে ‘আদর্শ বাগান’ ধরে দিলে এর পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় ‘আদর্শ বাগানের উপহার’। তবে ফার্সি শব্দে বুৎপত্তিগত অর্থানুসারে ‘বাগ’ মানে ‘খোদা’ এবং ‘দাদ’ মানে ‘সৃষ্ট বা প্রতিষ্ঠিত’, অর্থাৎ বাগদাদ মানে ‘খোদা প্রতিষ্ঠিত’। অবশ্য খলিফা মনসুর এর সঙ্গে মুসলিম ভাবাদর্শ অনুসারে জুড়ে দেন ‘মদিনা-আস-সালাম’ বা ‘শান্তির নগরী’। কালক্রমে যা ‘মাদিনা-আস-মনসুর’ বা ‘মনসুরের শহর’ পরিচিত হয়। আব্বাসীয়দের মুদ্রায়ও এ শহরের নকশা যুক্ত করা হয়। শহরের পশ্চিমার্ধ পরিচিত ছিল আজ-জাওরা, মানে ‘বাঁকানো’ নামে, যা শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা বাঁকা নদী টাইগ্রিসকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। পূর্ব বাগদাদ পরিচিত ছিল আর-রওয়া, মানে ‘ভাসাভাসা’ নামে। এটা নদীর স্রোতের কথাই ইঙ্গিত করত। স্থাপত্যশৈলীতে বাগদাদের বিশেষত্ব হচ্ছে, পূর্ণ বৃত্তের নির্মাণ। টাইগ্রিসের অদূরে ৮০ ফুট উঁচু দেয়ালঘেরা নগর ঘিরে আছে গভীর পরিখা। সমান দূরত্বে তার চার স্থানে চারটি গেট, দেখতে অনেক কলোসিয়াম বা উঠানে বানানো পাকা সূর্যঘড়ির মতো। খলিফা মনসুর এ নগরীর নকশা করে ছিলেন বহিরাক্রমণ মোকাবেলার পাশাপাশি বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে। দেয়ালের ভেতরে ২ হাজার ৫০০ ও বাইরে ৩ হাজার ২০০ গজ দূরত্বে অবস্থিত লোহার তৈরি প্রতিটি গেট নিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বৃত্ত। বৃত্তের দক্ষিণ-পশ্চিমে বাব আল-কুফা বা কুফা ও বাব আল-বসরা তোরণ অবস্থিত। উভয়ই সারাত নালার দিকে মুখ করে আছে। এছাড়া ট্রাইগিসের দিকে মুখ করে প্রথম দরজা বাব আল-খোরাশান বৃত্তের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সারাত নালার উত্তর পাড়ে অবস্থিত উত্তর-পশিম দিকের বাব আল-শাম (সিরিয়া/দামাস্কাস) তোরন চলে গেছে প্রথম সড়ক দিয়ে আনবার প্রদেশের দিকে। প্রতিটি তোরনই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নগরীকে যুক্ত করেছে। বৃত্তের ঠিক মাঝখানে প্রধান মসজিদের পাশেই অবস্থিত ‘খলিফার প্রাসাদ’, যার আরেক নাম ‘স্বর্ণদ্বার’। তবে আব্বাসীয় বংশের ২৮তম খলিফা আল-মুতাজির আরো চারটি তোরণ মাউদাম, শারকি, তালসিম ও ওয়াসতিন যোগ করেন। আব্বাসীয় বংশের পতনের আগ পর্যন্ত তা টিকে ছিল।
এগার শতকের আরব প-িত আল খতিব আল বাগদাদির ভাষ্যমতে, চারপাশে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু দেয়ালের এক-তৃতীয়াংশ নির্মাণ করতে ১ লাখ ৬২ হাজার ইট দরকার পড়েছিল। এর পরবর্তী দুই-তৃতীয়াংশ করতে ১ লাখ ৫০ হাজার এবং বাকি অংশ ১ লাখ ৪০ হাজার ইটের সাহায্যে সম্পন্ন হয়। সিরিয়া, পারস্য, বাইজেনটাইন এলাকা থেকে আনা হয়েছিলেন রোদে শুকানো, আগুনে পোড়ানো এই ইট। তৎকালীন ঐতিহ্য অনুযায়ী ইটের মধ্যেও আছে বৈচিত্র্য। ২০০ রাল্ট ওজনের ত্রিকোণ ইটের আকার ১৮ ইঞ্চি ও ১০০ রাল্টের বর্গাকার ইটের আকার ৯ ইঞ্চির মধ্যে। স্থাপত্যশৈলীর মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ বাগদাদের প্রসিদ্ধি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্যও। ৮৩০ সালে বৃত্তাকৃতি নগরীর ঠিক মাঝে ‘বায়ত আল-হিকমা’ বা ‘জ্ঞানগৃহ’ প্রতিষ্ঠা করেন আব্বাসীয় বংশের আরেক নক্ষত্র, জগৎখ্যাত খলিফা হারুন-অর-রশিদ। উমাইয়াদের বিধর্মী বিদ্বেষ ও আঞ্চলিক বিভাজনের বিপরীতে আব্বাসীয় বাগদাদ ছিল সব ধর্মমতের মানুষের আশ্রয়। এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সাবিয়ান প্রদেশের গণিতবিদ তাবিদ ইবন কুররা, পারস্যের বানু মুসা ভাইয়েরা, আজকের পাকিস্তানের সিন্ধি বিজ্ঞানী সিন্ধ ইবন আলি, আরব দর্শনের জনকখ্যাত ইরাকের আল-কিন্দি। এখানেই ছিলেন পারস্য গণিতবিদ আল-খারিজমি। তার নামানুসারে গণিতের লাতিন শব্দ আলগারিদমের উৎপত্তি, যা ইংরেজিতে গৃহীত হয় আরো পরে। নিজেদের সমৃদ্ধি জন্য বিশ্বের জ্ঞান মাতৃভাষায় অনুবাদের ওপর প্রাধান্য দিয়েছিল বাগদাদ। লাতিন, চীন, সংস্কৃত, সিরীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ থেকে বিস্তর অনুবাদ হয়েছে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিস্টটল, টলেমি, ইউক্লিড, ইপোক্রেতাস, পিথাগোরাসসহ গুরুত্বপূর্ণ সব দার্শনিক-প-িতের লেখাই অনুবাদ হয়েছে আরবিতে। কথিত আছে, মূল থেকে অনূদিত বইয়ের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দেয়া হতো অনুবাদককে। অন্যদিকে আরব দার্শনিক ইবন-রুশদ, পারস্যের ইবন-সিনা, আল-কিন্দির করা ফুটনোট ইউরোপে বিস্তর ছড়িয়ে পড়ে অনুবাদে। সে সময় বাগদাদসহ আশপাশের নগরে সুফি কবি ফেরদৌসী, শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, ফরিদউদ্দীন আত্তারের জন্ম সেই সমৃদ্ধিকেই নির্দেশ করে।
এ সময় কাগজ আবিষ্কার হয় চীন। সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদে এর ব্যবহার শুরু হয় ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে। এজন্য চীনের লোক নিয়োগ দিয়ে কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। দামাস্কাস, মিসর, মরক্কোয় কাগজের কারখানা স্থাপন করা হয়। ৯৫০ সালে এ কাগজের ওপর ভর করে আরবের দর্শন পৌঁছে যায় মুসলিম শাসিত স্পেনে। বিশেষ করে প্রখ্যাত সিল্করুট দামাস্কাস থেকে সরে বাগদাদে যুক্ত হওয়ায় বণিক-পর্যটকদের মাধ্যমে এর আরো বিস্তার ঘটে। ১২৫৮ সালে হালাকু খাঁর আক্রমণে তছনছ হয়ে যায় বাগদাদ। অজস্র খুন আর লুণ্ঠনে দিগম্বর হয়ে পড়েছিল নগরী। ধ্বংস করা হয় নালা আর সুরক্ষা ব্যবস্থা। বায়ত আল-হিকমার দুর্লভ নথি-বই পুড়িয়ে গরম করা হয়েছে গোসলের পানি, টাইগ্রিসে ফেলা হয় বই। কথিত আছে, ছাপার কালিতে নদীর পানি কালো হয়ে গিয়েছিল। খলিফা হারুন-অর-রশিদের পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ভাটা পড়েছিল জৌলুসে।
১৮৪৮ সালে স্যার হেনরি রলিনসন শুষ্ক মৌসুমে টাইগ্রিসের পানি একেবারে নিচে নেমে গেলে তীরে ব্যাবিলন আমলের ইটের তৈরি ইমারত আবিষ্কার করেন, যা হয়তো বাগদাদ নগরীরই ধ্বংসাবশেষ। তবে এশিরিয়ান ভূগোল পঞ্জির সাক্ষ্য অনুযায়ী, নেবুচাদনেজারের মুখাবয়ব খচিত ব্যাবিলনীয় আমলের এই ইট সার্দনপালুস শাসন আমলে তৈরি। তার মানে আল-মনসুর রাজধানী স্থাপনের বহু আগেই সেখানে নগরী ছিল। আরব ঐতিহাসিকদের মতে, তার একটা নিদর্শন হলো, সাসানি বংশের শাসনামলে টাইগ্রিসের পশ্চিম পাড়ে ‘বাজার’ বসার ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাস হয়তো জীবনানন্দ দাশের এশিরিয়ার ধুলো আর ব্যাবিলনের ছাই হয়েই আছে। ইরাক যুদ্ধ নিয়ে হলিউডের প্রপাগান্ডা সিনেমা হার্ট লকার কিংবা যুদ্ধপরবর্তী সময়ে অমিতাভ ঘোষের প্রবন্ধে ইরাক প্রবাসী মিসরীয় যুবকের বয়ানে সেই বাগদাদকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ( বণিকবার্তার সিল্করুট এর সৌজন্যে)
সূত্র: Baghdad: during the Abbasid Caliphate, Guy Le Strance, Oxford press, 1901
Baghdad: city of peace, city of blood; Justin Marozzi, Da Capo Presss, UK, 2014
The golden age of Baghdad, Youssef El Kaidi, Inside Arabia, Sep 19, 2020
The birth of Baghdad was a landmark for world civilisation, Justin Marozzi, The Gaurdian, 16 March, 2016 ( লেখক: অলাত এহ্সান: গল্পকার, প্রাবন্ধিক