রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে চলতি মাড়াই মৌসুমে ছয়টি মিলের উৎপাদন কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। মিলগুলো হচ্ছে পঞ্চগড় সুগার মিল, সেতাবগঞ্জ সুগার মিল, শ্যামপুর সুগার মিল, রংপুর সুগার মিল, পাবনা সুগার মিল ও কুষ্টিয়া সুগার মিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোতে ১ লাখ ১৫ হাজার টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৮২ হাজার টন। ছয়টি মিল উৎপাদন স্থগিত ঘোষণা করায় চলতি মৌসুমে চিনি উৎপাদন ৬০-৬৫ হাজার টনে নেমে আসবে। ফলে বাধ্য হয়ে বিএসএফআইসি ডিলার পর্যায়ে চিনি বিক্রি কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী চিনি না পাওয়ায় এরই মধ্যে চিনির ডিলারশিপ বাতিলে ঝুঁকছেন নিবন্ধিত ব্যবসায়ীরা। বিএসএফআইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে শরবত, জুস জাতীয় খাবারের চাহিদা বেশি থাকায় চিনির বিক্রিও বেড়ে যায়। তবে শীত মৌসুমে শরবত কিংবা জুসের চাহিদা কমে যাওয়ায় চিনির চাহিদাও কম থাকে। ফলে এ সময়ে চিনির দামও সহনীয় পর্যায়ে থাকে। কিন্তু চলতি বছর শীতে চিনির দাম কমে যাওয়ার কথা থাকলেও উল্টো দাম বাড়ছে। সরকারি চিনিকল নিয়ে নানা গুঞ্জনের কারণে চিনির মজুদ প্রবণতায় পণ্যটির বাজার হঠাৎ করেই অস্থির হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৫ থেকে ১৭ লাখ টন। এর মধ্যে এক লাখ টনেরও কম চিনি আসে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো থেকে। বাজারের চাহিদা পূরণে অবদান খুব সামান্য হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন স্থগিত রাখার ঘোষণাকে সুযোগ হিসেবেই নিচ্ছেন বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা। কয়েক দফায় চিনির দাম মণপ্রতি প্রায় ৪৫০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা। যদিও এর কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে বুকিং দর বৃদ্ধির কথাই বলছেন তারা।
গত রোববার বিশ্ববাজারে চিনির বুকিং মূল্য ছিল প্রতি পাউন্ড ১৫ দশমিক ৬০ সেন্ট। বুকিং মূল্যের সঙ্গে ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধন ও বাজারজাত মূল্য যুক্ত করলে প্রতি মণ চিনির দাম ১ হাজার ৯০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। অথচ বর্তমানে পাইকারি বাজারে প্রতি মণ চিনি ২ হাজার ৩৫০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে এটিই চিনির সর্বোচ্চ দাম।
বেসরকারি খাতের যে কয়েকটি চিনিকল আমদানি করা চিনি পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিটি সুগার, ফ্রেশ সুগার, আবদুল মোনেম সুগার ও দেশবন্ধু সুগার মিল। বাজারের সিংহভাগই তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির আগেই বাজারে সরবরাহ আদেশ (ডিও) ছেড়ে অর্থ উত্তোলন করে। এসব ডিও বাজারে বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত মিলগেট থেকে পণ্যটি উত্তোলন করে সর্বশেষ পাইকারি বিক্রেতা। এ প্রক্রিয়ার মধ্যেই ডিওর প্রকৃত মূল্য থেকে অনেক বেড়ে যায় চিনির দাম। মূলত ডিও কেনাবেচার মাধ্যমে দাম বাড়ানোর সুযোগ থাকায় আমদানিকারকদের বিক্রি করা দামের চেয়েও অনেক বেশি মূল্যে চিনি বিক্রি হয়। যার প্রভাব পড়ে দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার পাইকারি বাজারে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ তেজি) চিনি বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ২৫০ টাকা। সর্বশেষ গতকাল দাম ১৫০ টাকা বেড়ে ডিও পর্যায়ে প্রতি মণ চিনি লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে মিলগেট থেকে সরাসরি উত্তোলনযোগ্য চিনি বিক্রি হচ্ছে আরো বেশি দামে, মণপ্রতি ২ হাজার ৩৭০ থেকে ২ হাজার ৩৮০ টাকায়। কয়েক দিনের ব্যবধানে চিনির দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পাইকারি পর্যায়ে পণ্যটির লেনদেনও বেড়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে উৎপাদন স্থগিতের কোনো সুবিধা বেসরকারি খাত পাচ্ছে না দাবি করে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো উৎপাদন করে মাত্র ৭০-৮০ হাজার টন। এছাড়া সব কলে উৎপাদন বন্ধও হয়নি। কাজেই তাদের জন্য বাজারে প্রভাব পড়ার কোনো সুযোগ নেই। চিনির দাম বৃদ্ধির মূল কারণ আন্তর্জাতিক বাজার। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনার প্রভাব মারাত্মক। ওই দেশগুলোতে যে পণ্যগুলো উৎপাদন হয় সেগুলোর মূল্য অনেক বেড়ে গেছে, যেমন সয়াবিন তেল, পাম তেল। এভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির মূল্য বেড়েছে, যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে স্থানীয় বাজারে।
চিনি উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ খুব একটা বেশি কখনই ছিল না বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) চিনিকলগুলোর। তার পরও বাজারে চিনির দামের নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রভাব ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এসব চিনিকলের। কিন্তু লোকসানের বোঝা কমাতে চলতি মৌসুমে ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন স্থগিত রেখেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিএসএফআইসির ডিলার/ফ্রি সেল পর্যায়ে চিনির দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা। বর্তমানে সরকারি চিনির দামের চেয়েও বেড়ে গেছে বেসরকারি মিলের চিনির দাম। কিন্তু ডিলাররা চাহিদা সত্ত্বেও চিনি না পাওয়ায় বেসরকারি মিলের চিনির দাম বেড়েই চলেছে। চলতি মৌসুমে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় চিনিকলের উৎপাদন স্থগিতের ঘোষণায় আগামীতে উৎপাদন কমে এলে বেসরকারি চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে বিএসএফআইসি ভূমিকা হারাবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি মিলগুলো চিনি পরিশোধন করলেও দেশে চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে একসময় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল নিয়ে অস্থিরতা, সরকারি চিনির সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সংকটে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে বেসরকারি মিলগুলোর দাম নিয়ে কারসাজি করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকারি চিনিকলের উৎপাদন কমে এলেও টিসিবি কিংবা সরকারি অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে চিনি আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলে দেশে চিনির দাম আরো অস্থির হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।