প্রতারণা করাই তার পেশা। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর পরিচয় দিয়ে বিপুল পরিমাণ ফান্ড সংগ্রহ করার প্রলোভন দিতেন। এই ফান্ড ছাড় করাতে কমিশন হিসেবে লাখ লাখ টাকা সংগ্রহ করতেন। এরপরই আত্মগোপনে চলে যেতেন।
তবে যেনতেন ভাবে নয়, প্রতারণার জন্য রীতিমতো ব্যয়বহুল যান হেলিকপ্টার ভাড়া করতেন তিনি। যাতে টার্গেটকৃত ব্যক্তিরা সহজেই তার প্রতি আস্থা আনে। তার টার্গেট ছিল ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি।
অভিনব ও বিলাসী জীবন যাপন করা এই প্রতারকের নাম রুবেল আহম্মেদ। রবিবার (১৭ জানুয়ারি) রাতে ঢাকার কাউন্টার টেররিজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ইকোনোমিক অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং টিমের সদস্যরা তাকে উত্তরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে পাঠানো হয়েছে।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অভিনব কৌশলে রুবেল আহম্মেদ সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। তার টার্গেট ছিল জনপ্রতিনিধি। তার কাছ থেকে বিদেশি একটি সংস্থার ভুয়া কাগজপত্র, সিল, প্যাড উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সিটিটিসি সূত্র জানায়, প্রতারক রুবেল আহম্মেদ সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার ৩ নং বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন করে সেখানে জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, দারিদ্রপীড়িত লোকের তালিকা প্রস্তুত করে। এজন্য সে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাত করে। ইউপি চেয়ারম্যানকে প্রতারক রুবেল আহম্মেদ জানায়, তার কাছে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার একটি অনুদান রয়েছে। এই অনুদানের অর্থ দিয়ে সে গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত ও দরিদ্র লোকদের আবাসন নির্মাণ, স্কুল নির্মাণ, নদীভাঙন রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, কৃষকদের ডিপ টিউবওয়েল প্রদান, দুস্থদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তার কথায় আস্থা অর্জন করে এলাকার দরিদ্র পরিবারদের মধ্যে দুই শ’ জনের একটি তালিকা তৈরি করে।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, এলাকার মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য সে প্রাথমিকভাবে কিছু ইট ক্রয় করে এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির জমি ক্রয়ের জন্য দেড় লাখ টাকা বায়নাও করে। এসব কাজ তদারকি ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিং করার জন্য সে ঢাকা থেকে তিনবার হেলিকপ্টার নিয়ে কুষ্টিয়ায় ভ্রমণ করে। পরবর্তীতে প্রজেক্টের অর্থ ছাড় করাবার জন্য আড়াই শতাংশ বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনজিও ব্যুরোর কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হবে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানায়। একই সঙ্গে প্রজেক্ট থেকে অর্ধেক অর্থ ব্যয় করে বাকি অর্ধেক তাদের মুনাফা হিসেবে ভাগ করে নিতে পারবে বলে প্রলোভন দেখায়। প্রতারক রুবেলের এই প্রস্তাবে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি দুই দফায় এই প্রতারকের হাতে ৪৩ লাখ টাকা তুলে দেয়। টাকা হাতে পাওয়ার পর প্রতারক রুবেল আহম্মেদ মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতারক রুবেল আহম্মেদ নিজেকে কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন নামে একটি কথিত সংস্থার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে পরিচয় দিতো। উত্তরার একটি হোটেল কাম বাসার কক্ষ ভাড়া নিয়ে অবস্থান করতো। কুষ্টিয়া থেকে যারা আসতো তাদের সঙ্গে ওই কক্ষেই সে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করতো। রাজধানীর উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় থাকতো। লিটন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে একটি এনজিওতে কিছুদিন চাকরি করেছে সে। ওই এনজিওতে চাকরি করার সময় প্রতারণার এই অভিনব কৌশল তার মাথায় আসে।
পুলিশ জানায়, প্রতারক রুবেল একই কৌশলে এর আগে মাগুরা ও খাগড়াছড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতারণা করে আত্মসাৎ করে। সে ২০০৭ সালে মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেড় বছর অবস্থান করার পর দেশে চলে আসে। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। রাজধানী ছাড়াও কুষ্টিয়া, মাগুরা ও খাগড়াছড়িতে তার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে। সূত্র জানায়, প্রতারক রুবেল আহম্মেদের কাছ থেকে যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে তাতেও বাবার নাম দুই ধরণের পাওয়া গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম-ঠিকানা ঠিক থাকলেও পাসপোর্টে নিজের খালুর নাম বাবার নামের জায়গায় বসিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে রুবেল জানিয়েছে, সে ইচ্ছা করেই পাসপোর্টে বাবার নাম ভুল দিয়েছিল। যাতে প্রতারণা করে দেশের বাইরে চলে গেলে তাকে আর কেউ খুঁজে বের করতে না পারে। সিটিটিসির তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, রুবেলকে দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সে আর কোথায় কোথায় এবং কি কৌশলে প্রতারণা করেছে এবং প্রতারণা করে আয় করা অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করেছে তা জানার চেষ্টা করা হবে।-বাংলাট্রিবিউন