সীমিত আয়ের মানুষ বা যাদের কম বেতন এক কথায় তারা এই করোনাকালে সংকটে আছেন। বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে যারা চাকরি করছেন, তারা নানামুখী সমস্যায় ভুগছেন। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন বেসরকারি খাতের কোনও প্রতিষ্ঠানে চাকরির ওপর নির্ভরশীলরা। এরই মধ্যে যাদের কম বেতন, তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকেও অনেকে চাকরি হারিয়ে এলাকায় ফিরে গেছেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে কম বেতনে চাকরি করা অনেকেই চাকরি হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড .আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাকালে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, অনেকেরই আয় কমে গেছে। যে পরিবারের একমাত্র আয় করা ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, সেই পরিবারের পরিস্থিতি ভয়ানক বলে মনে করেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, করোনাকালে বেশি বেতন পাওয়াদের মধ্যে যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। কিন্তু কম বেতনে চাকরি করতের যারা তারা উদ্যোক্তা হতে পারছেন না। ফলে তারা হয়ত এখন বেকার। তিনি বলেন, তুলনামূলকভাবে সরকারি কর্মচারী সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমেনি, বরং বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম এ খালেক বলেন, করোনাকালে সবাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে বেসরকারি কর্মচারীরা বেশি সমস্যায় পড়েছেন। তার মতে, সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন। করোনাকালে ডিউটি করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন অনেকেই। কিন্তু এ নিয়ে কর্মচারীরা কাউকে কিছু বলতে পারে না। কারণ তাদের কথা বলার কোনও জায়গা নেই। তাদের কথার গুরুত্ব দেওয়ারও কেউ নেই। রাজধানীর মানিক নগর এলাকার একটি ১০ তলা ভবনে দারোয়ানের চাকরি করেন মো. জয়নাল হোসেন। তিনি বলেন, করোনাকালে কয়েকজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দেওয়ার কারণে তাকে ভবনের বাসিন্দারা ঠিকমতো বেতন দেয়নি। এখন পর্যন্ত তার ২ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা অরনেট গ্রুপের সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, করোনার সময়কালে জিনিসপত্রের দাম বেশি ছিল। ওই সময় তার অতিরিক্ত কোনও আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় ঠিকই বেড়েছে।
করোনায় ঢাকার একটি গার্মেন্ট কারখানা থেকে চাকরি হারানো পাবনার ভাঙ্গুড়ার সোহেল রানা জানান, চাকরি হারিয়েই তিনি শুরু করেছেন মাছের ব্যবসা। ভোরে আড়ত থেকে মাছ কিনে এলাকার বাজারে বিক্রি করছেন। ঢাকার আরেকটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করতেন মাসুদ রানা। লকডাউন চলাকালে বাড়িতে চলে আসার পর চাকরিটা আর ফিরে পাননি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক যৌথ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ লাখ তরুণ কাজ হারিয়েছে। ‘ট্যাকলিং দ্য কোভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত বছরের আগস্টে প্রকাশ হয়। অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, করোনার তা-বে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৬৬ শতাংশ মানুষ আর গ্রামাঞ্চলের ৪১ শতাংশ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন। শহরাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। ‘লুজিং লাইভলিহুডস: দ্য লেবার মার্কেট ইম্প্যাক্টস অব কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি কর্মক্ষেত্রে করোনার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানার জন্য গত ১০ জুন থেকে ১০ জুলাই ফোনকলের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি করা হয়েছে। তবে এ প্রতিবেদন তৈরিতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার’ জরিপের ফলাফলও বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কর্মহীন হয়েছে ঢাকায়। এখানে ৭৪ শতাংশ মানুষে তাদের চাকরি হারিয়েছেন। ঢাকা বিভাগের গ্রামাঞ্চলের ৪৫ শতাংশ মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন এই করোনায়। গ্রামাঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মহীন হয়েছে বরিশাল বিভাগে। এখানে চাকরি হারিয়েছেন ৪৭ শতাংশ চাকরিজীবী। এই বিভাগের শহর এলাকার চাকরি হারিয়েছেন ৫৪ ভাগ। আইএলও ও এডিবি’র যৌথ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, করোনা ও লকডাউনের কারণে বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদে চাকরি হারিয়েছেন ১১ লাখ ১৭ হাজার তরুণ। দীর্ঘমেয়াদে তা বেড়ে ১৭ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তরুণদের চাকরি হারানোর সাতটি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে কৃষি খাতে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ, খুচরা বাণিজ্য খাতে ১২ দশমিক এক শতাংশ, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাতে দুই দশমিক ছয় শতাংশ, অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা খাতে সাত দশমিক চার শতাংশ, নির্মাণ খাতে ১২ দশমিক আট শতাংশ, টেক্সটাইল খাতে ১৩ দশমিক ছয় শতাংশ ও অন্যান্য সেবা খাতে চাকরি হারিয়েছেন চার দশমিক পাঁচ শতাংশ।
এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, করোনার কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছে মোট দেড় কোটি মানুষ। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, করোনার কারণে ৮০ শতাংশ যুবকের আয় কমে গেছে।-বাংলাট্রিবিউন