সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন

নারীর মর্যাদা ও ইসলাম

উম্মেহানি বিনতে আবদুর রহমান
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

অধঃপতনে পূর্ণ এ সময়ে নারীদের সূর্যের আলোয় পথ চলা ত্রাসের বিষয়। ইসলাম নারীদের কিভাবে উপস্থাপন করে? ইসলামে একজন নারীর ভূমিকা কী? মুসলমান নারীরা কি নির্যাতিত? (উপরিউক্ত প্রশ্নগুলো এখনো মানুষের মনে ঘুরপাক খায়)। মৌলিক ও মানবিক অধিকারের ক্ষেত্রে এবং ধর্মের যাবতীয় কর্মের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীদেরকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। একটি ইসলামিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা কন্যাশিশু তার জন্ম সূত্রে পাওয়া ইসলামিক কৃষ্টি-কালচারে জীবন শুরু করে, বলা হয়ে থাকে ছেলেসন্তান জন্মগ্রহণ করার সময় একটি নূর নিয়ে আসে এবং মেয়েসন্তান জন্মগ্রহণ করার সময় দু’টি নূর নিয়ে আসে।
রাসূলুল্লাহ সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘যার গৃহে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করল, অতঃপর সে তাকে (কন্যাকে) কষ্টও দেয়নি, তার ওপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্রসন্তানকে প্রাধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন’ (মুসনাদে আহমদ, ১:২২৩)।
নারী যখন কন্যা : ইসলাম পূর্ব যুগে কন্যাসন্তানের জন্ম লজ্জার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতো। ইতিহাসে স্পষ্ট জীবন্ত কন্যাশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই মাটিচাপা দেয়ার রীতি ছিল জাহেলিয়াতের বর্বর যুগে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন জ্যান্ত দাফনকৃত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, কোন অপরাধে তাকে দাফন করা হয়েছিল (তখন কী জবাব দিবে তোমরা)? (সূরা আত-তাকভীর : ৮-৯)।
ইসলাম কন্যাশিশুর জন্মকে সৌভাগ্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, নারীকে দিয়েছে প্রাপ্য মর্যাদা। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা তোমাদের মেয়েদের অপছন্দ করো না। কারণ তারা অন্তরঙ্গতা পোষণকারী মূল্যবান সম্পদ’ (মুসনাদে আহমদ, ১৭৩০৬)।
পরিবারের প্রতি পুরুষের অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে কিন্তু মেয়েদেরকে সে দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে রাখা হয়েছে। তবুও ইসলাম কন্যাদেরকে জান্নাতে যাওয়ার পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
রাসূল সা: বিভিন্ন হাদিসে কন্যাসন্তানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদেরকে জান্নাতের পথ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ‘যে ব্যক্তি দুইজন কন্যাসন্তানকে লালনপালন ও দেখাশোনা করল (বিয়ের সময় হলে ভালো পাত্রের কাছে বিবাহ দিলো) সে এবং আমি জান্নাতে এরূপ একসঙ্গে প্রবেশ করব যেরূপ এ দু’টি আঙুল। তিনি নিজের দুই আঙুল মিলিয়ে দেখালেন (জামে তিরমিজি, হাদিস ১৯১৪)।
নারী যখন স্ত্রী : উম্মাহাতুল মুমিনিনদের প্রতি রাসূল সা:-এর আচরণ সীরাতের শুভ্র পাতায় বর্ণিত রয়েছে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায়, সংসারে জান্নাতি শান্তি বজায় রাখতে হলে সীরাত সম্পর্কে উম্মাহর সব স্বামীর জ্ঞান রাখা অত্যাবশ্যক। মা আয়েশা রা: হতে বর্ণিত, নবী সা: সারা জীবনে কোনো নারীকে প্রহার করেননি বরং যখনই ঘরে প্রবেশ করতেন (তাঁর মনের অবস্থা যেমনই হোক) পবিত্র মুখম-ল হাসিতে উদ্ভাসিত থাকত। তিনি নিজের কাজ নিজে করা পছন্দ করতেন এমনকি ছেঁড়া জুতা নিজের হাতে সেলাই করতেন (শামায়েলে তিরমিজি)।
নারী ও পুরুষের মৌলিকভাবে সমান অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ বলেন, এবং নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমন আছে পুরুষদের (সূরা বাকারা : ২২৮)।
একসাথে পথ চলতে গেলে একের ত্রুটি অন্যের দৃষ্টিতে ধরা পড়বে এটাই স্বাভাবিক। পূর্ণতা কোনো মানুষেরই নেই, দোষত্রুটি মিলিয়েই মানুষ। প্রত্যেক পুরুষের উচিত নিজেদের স্ত্রীদের ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা এবং স্ত্রীর গুণগুলোর জন্য তার সম্মুখে প্রশংসা করা ও শোকরিয়া আদায় করা । মহান রাব্বুল আলামিন বলেন,
আর তোমরা স্ত্রীদের সাথে বসবাস করো সদাচারের সাথে, আর যদি (কোনো কারণে) তোমরা তাদেরকে অপছন্দ করো তাহলে হতে পারে যে, তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ করলে আল্লাহ তাতে প্রচুর কল্যাণ রেখে দিলেন (সূরা নিসা : ১৯)।
নারী যখন মা : যার তুলনা অন্য কারো সাথে চলে না তিনিই মা। ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করেছে মায়ের দিক থেকেই, শুধু মানুষ নয় বরং পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই তার মায়ের কাছে ঋণী।
সুনানে আবু দাউদের বর্ণনায় আছে, ‘মা বেহেস্তের মধ্যবর্তী দরজা।’
বর্তমানে কিছু দুর্ভাগা মা-বাবার অমর্যাদা করে দুনিয়ার সাময়িক উপকরণের মায়াজালে পড়ে নিজেদের সুখী ভাবছে, অথচ সন্তানের বিপদে-সঙ্কটে যে মানুষটি স্নেহের পরশ বিছিয়ে দেন তিনিই মা, সেই মাকে কষ্ট দিয়ে প্রকৃতপক্ষে শান্তি পাওয়া অসম্ভব। পুত্র নবী হলেও মাকে ইজ্জত করতে হয়; ঈসা আ: বলেন, আল্লাহ আমার মাকে শ্রদ্ধা ও তার সঙ্গে পুণ্যময় আচরণ করতে বলেছেন।
সন্তান যদি তার মায়ের অবাধ্য হয় তবে তাকে তওবা করতে হবে, কোনো পুণ্যময় রাত-দিনের মুহূর্তেও মায়ের অবাধ্য সন্তানকে ক্ষমা করা হবে না, ইসলাম মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। এই ব্যাপারে কিছু হাদিসের বর্ণনা-
রাসূল সা: বলেন, তিন ধরনের দোয়া অবশ্যই কবুল হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১. মজলুমের দোয়া ২. মুসাফির বা সফরকারীর দোয়া ৩. সন্তানের জন্য মাতা-পিতার দোয়া (তিরমিজি)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম।’ (ইবনে মাজাহ-মিশকাত,পৃ. ৪২১)
যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সাওয়াব দান করেন (বায়হাকি-মিশকাত, পৃ. ৪২১)।
পশ্চিমা বিশ্বের নানান অপসংস্কৃতি মুসলিমদের মাঝে প্রবেশ করেছে, এর একটি ‘বিশ্ব মা দিবস’ মূলত অমুসলিমরা বছরে এক দিন মায়ের প্রতি আনুষ্ঠানিকতা দেখায় আর ইসলাম প্রতিদিনই মায়ের প্রতি লক্ষ রাখতে বলেছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, চিরন্তন শাশ্বত নির্দেশনা। ইসলামে ‘মা’ হচ্ছেন স্নেহের আঁধার, পুণ্যবতী, সন্তানের শুভ কামনাকারী, সুখ ও মানবতাময় এক শান্তির অতুলনীয় ঠিকানা। নারী যখন মা, তখন তার মর্যাদাও লাখ গুণ বৃদ্ধি পায়। একজন সাহাবি রাসূল সা:-এর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছে খেদমত পাওয়ার বেশি হকদার কে? তখন রাসূল সা: বলেছিলেন তোমার মা, দ্বিতীয় তোমার মা, তৃতীয় তোমার মা এবং চতুর্থ তোমার বাবা (সহিহ বুখারি)।
অমর্যাদা আর গ্লানির কব্জা থেকে মুক্ত করে ইসলাম নারী জাতিকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। পর্দাশীল পুণ্যবতী নারী নিজের বাবা, ভাই, স্বামী এবং সন্তানের জান্নাতের মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। কোনো নারী যদি সন্তান প্রসবকালীন মৃত্যুবরণ করে তবে সে আল্লাহর দরবারে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে (সুবহান আল্লাহ)। একজন কন্যা, একজন স্ত্রী এবং একজন মা হিসেবে ইসলাম নারীকে এমন ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে উপস্থাপন করেছে যে মানমর্যাদার ক্ষেত্রে নিজ নিজ স্থান শৈল্পীকতার সাজে সুসজ্জিত।
বর্তমান সময়ের চলমান ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রতিটা চিন্তাশীল ব্যক্তিই অবগত,পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারে অভ্যস্ত হয়ে চলাফেরা করার দরুন বর্তমান নারীসমাজ এক তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছে। ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে পড়া চারদিকের এ বিরান ভূমিকে সজীব করে তুলতে প্রয়োজন আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের বাস্তবায়ন। কারণ এতেই রয়েছে পার্থিব নানাবিধ কল্যাণ এবং আখিরাতে চিরস্থায়ী জান্নাতপ্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ। প্রতিটি নারী যদি ইসলামিক নির্দেশনায় নিজেদের আত্মসম্মান বুঝতে পারত তাহলে প্রতিটি ঘর হয়ে উঠত জান্নাতি আমেজের; রব্বে কারীম আমাদেরকে তার বিধান বোঝার এবং তাঁর বিধান মাফিক জীবন যাপনের জান্নাতি সৌভাগ্য দিন, আমীনএলেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com