মহানুভবতা মানুষের অনন্য গুণ। পৃথিবীতে কেউই মহানুভব হয়ে জন্মায় না; নিজের কর্মগুণে মহানুভবতা অর্জন করতে হয়। মানবতার কল্যাণে হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিতে প্রয়োজন বিরাট সাধনার; প্রয়োজন সবচেয়ে বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষের আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার। প্রিয়নবী (সা.) ছিলেন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। এ বিষয়ে তিনি সরাসরি আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিলেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নিজেই তার হৃদয়ের বিশালতা ও মহানুভবতার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কি আপনার কল্যাণে আপনার হৃদয় প্রশস্ত করে দেইনি?’ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত : ১) অর্থাৎ, আমি আপনার হৃদয় বিশাল-বিস্তৃত করে দিয়েছি এবং আপনাকে মহানুভব রাসুল হিসেবেই প্রেরণ করেছি। মহানুভবতা অর্জনের জন্য রাসুল (সা.) বেশ কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বাতলে দিয়েছেন আকাশসম হৃদয়ের অধিকারী হওয়ার উপায়, যা ধারণ করতে পারলে নিজের ভেতর থাকবে না কোনো সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতা, অনুভব করা যাবে পৃথিবীর বাইরের বিশাল জগৎ ও পরকালকে। মহানুভব হওয়ার কয়েকটি উপায় এখানে তুলে ধরছি।
তাওহিদ : আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এ কথার প্রতি অবিচল আস্থা হৃদয়ের দুয়ার খুলে দেয়। এ বিশ্বাস যত বলিষ্ঠ ও ষোলকলায় পূর্ণ হয়, বিশ্বাসী মানুষের হৃদয় ততই প্রশস্ত হয়। হৃদয়ে রোপিত হয় মহানুভবতার বীজ। আল্লাহ বলেন, ‘ইসলামের জন্য আল্লাহ যার বক্ষ উন্মোচিত করে দিয়েছেন, যার ফলে সে তার প্রতিপালকের দেওয়া আলোর ওপর রয়েছে (সে কি তার সমান যে কঠোর হৃদয়ের)? ধ্বংস তাদের জন্য যাদের অন্তর আল্লাহ স্মরণের ব্যাপারে আরও শক্ত হয়ে গেছে। তারা স্পষ্ট ভ্রান্তিতে আছে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ২২)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যাকে সৎপথ দেখাতে চান, তার অন্তর ইসলামের জন্য খুলে দেন, আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তার অন্তর সংকীর্ণ-সংকুচিত করে দেন, যেন সে আকাশে আরোহণ করছে! যারা ইমান আনে না তাদের ওপর আল্লাহ এভাবে লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেন।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১২৫)
ইবাদত : আল্লাহর ইবাদত ও রাসুলের আনুগত্য বিশ্বাসী মানুষের হৃদয় আলোকিত করে। আর আলোকিত হৃদয় থেকেই জন্ম হয় মহানুভবতার। আমল যত বাড়বে, হৃদয়ের আলোও তত বাড়বে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হৃদয় আলোকিত হলে তা উন্মুক্ত ও প্রশস্ত হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করা হলো, ‘তার আলামত কী হবে হে আল্লাহর রাসুল?’ তিনি বললেন, ‘জান্নাতের চিরস্থায়ী জীবনের প্রতি মনোযোগী হওয়া, গর্ব-অহংকারের দুনিয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং মৃত্যুর আগে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।’ (বায়হাকি, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা. ২৫৮)
জ্ঞান-বিজ্ঞান : জ্ঞান মানুষের হৃদয়ের দুয়ার খুলে দেয়। জ্ঞানীর হৃদয় আকাশের চেয়েও বিশাল-বিস্তীর্ণ। মানবতার কল্যাণে নিবেদিত জ্ঞানই পারে মানুষকে মহানুভব করতে। এ ক্ষেত্রে কোরআন-হাদিসের জ্ঞানের ভাণ্ডার অগ্রগণ্য। এই জ্ঞান যারা বক্ষে ধারণ করতে পারেন, তারাই পৃথিবীর মহানুভবতম মানুষ, সুন্দরতম চরিত্রের অধিকারী হন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ তারাই।
তওবা : আল্লাহর দরবারে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করলে হৃদয় প্রশস্ত হবেই। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ‘করা’ এবং তার অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ‘না করা’ প্রকৃত মুসলমানের পরিচায়ক। এটিই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। এই ভালোবাসা কত মধুর, শুধু তারাই জানে, যাদের হৃদয় আল্লাহর ভালোবাসায় ভরপুর। সেই সুখানুভূতি প্রকাশ করার সাধ্য শব্দ-বাক্য-ভাষার নেই। পক্ষান্তরে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে গেলে হৃদয় সংকুচিত হয়ে পড়ে। বুকজুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। দুনিয়ার মোহ মানবমনে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করে। বিশাল পৃথিবী তার কাছে হয়ে পড়ে কারাগারের সংকীর্ণ কুঠির। তাই তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসাই মহানুভব মানুষের গুণ।
আল্লাহর স্মরণ : মানবমন সর্বদা মহান কাউকে স্মরণ করতে পছন্দ করে। আর বিশ্বাসীরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকেই স্মরণ করে থাকেন। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ হৃদয় উন্মুক্ত করে; অন্তর প্রশান্ত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জেনে রেখো, আল্লাহর স্মরণে হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ, আয়াত : ২৮)
সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা অনিবার্য সত্য। তাই সৃষ্টি জগতের কাউকে মহান হিসেবে স্মরণ করলে মানুষের মন পরিতৃপ্ত হতে পারে না। অপূর্ণতা-দুর্বলতার দিকগুলো তাকে হতাশায় ডোবায়। এক বুক কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত করে এসব লোক।
দান-সদকা : আল্লাহর পথে দান করলে মহানুভব হওয়া যায়। সৃষ্টির কল্যাণ কামনা ও মানবসেবায় আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। দানশীল মানুষ বড়ই সুখী হন। কৃপণের অন্তর খুবই ছোট। জীবনে তার দুঃখের অন্ত নেই। রাসুল (সা.) দানশীল ও কৃপণের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘দুই ব্যক্তির সামনে লোহার দুটি প্রাচীর। একজন দান করে, সেই প্রাচীর আস্তে আস্তে খুলে যায় এবং জায়গাটা তার জন্য প্রশস্ত হয়ে যায়। আরেকজন দান করে না, সেই জায়গাটা আগের মতোই সংকীর্ণ রয়ে যায়; মোটেও প্রশস্ত হয় না।’ (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৮৭০)
সাহস : সাহস মানুষের হৃদয় উন্মুক্ত করে; তাকে মহানুভব করে। মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয় সৎ সাহস। ভীরু-কাপুরুষ আজীবন সংকীর্ণমনা রয়ে যায়। নিজেও সুখী হতে পারে না, অন্যকে সুখ উপহার দিতে পারে না। ফলে মহানুভব হওয়ার স্বপ্ন তার জন্য অধরাই রয়ে যায়।
আত্মশুদ্ধি : মহানুভব হতে চাইলে মনের ভেতরের সব মরীচিকা পরিষ্কার করতে হবে। আত্মাকে করতে হবে পরিশুদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তার আয়াতসমূহ এবং তাদের পবিত্র করেন।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ২)
পরিমিতি বোধ : জীবনের কোনো কাজেই অতিরঞ্জন কাম্য নয়। মহানুভব হতে চাইলে পরিমিতি বোধের গুণ আয়ত্ত করতে হবে। ভোজন-বিলাসিতা পরিহার করতে হবে। মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশা কমাতে হবে। অতিরিক্ত ঘুমও পরিত্যাজ্য। বাচালতাও কল্যাণ বয়ে আনে না। এসব অতিরঞ্জন দুঃখই বাড়ায়। দুনিয়া-আখিরাতে বেশির ভাগ শাস্তিই অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘনের কারণে হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯০)