রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

জগতের সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি ও অকৃপণ দান। ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহ তাআলার সেরা নেয়ামত; ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা-৩০ রুম, আয়াত: ২২, ২১; পারা: ২১)।
সব মানুষ একই পিতামাতার সন্তান। সবারই পিতা আদম (আ.), সবারই মাতা হাওয়া (আ.)। তাই সব মানুষ ভাই ভাই, তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নাই। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো সে তো আল্লাহর সৃষ্টি। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩, পারা: ২৬)।
বিদায় হজের ভাষণে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারি শরিফ)। সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয় জ্ঞান করা যাবে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না এবং অবহেলা করা যাবে না; কেননা, ভাষার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ। তাঁর সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তাঁর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহ তাআলা মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন। তাঁদের ধর্ম প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত বা মহা সত্যের প্রতি আহ্বান। আর এর জন্য ভাষার কোনো বিকল্প ছিল না। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা-১৪ ইবরাহিম, আয়াত: ৪, পারা: ১৩)।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবেসো; যেহেতু আমি আরবি ভাষায় কথা বলি, কোরআন আরবি ভাষায় লেখা এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ (বুখারি)। কিন্তু আরবি পরকালের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সব নবী-রাসুল আরবি ভাষাভাষী ছিলেন না; এমনকি সব আসমানি কিতাবও আরবি ভাষায় লেখা হয়নি। আমরা জানি, তাওরাত কিতাব ইবরানি ভাষায় হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়; জাবুর কিতাব ইউনানি ভাষায় হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়; ইঞ্জিল কিতাব সুরিয়ানি ভাষায় হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর নাজিল করা হয়; এবং সর্বশেষ আসমানি কিতাব কোরআন আরবি ভাষায় সর্বশেষ নবী ও রাসুল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাজিল করা হয়।
সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন আরবি ভাষায় নাজিল করার কারণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘ইহা আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সূরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ২, পারা: ১২)। অর্থাৎ আরবদের কাছে আরবি ভাষাভাষীর নবী ও আরবি কিতাব আল কোরআন নাজিল করা হয়েছে। কারণ, তাদের মাতৃভাষা আরবি; অনারবি ভাষায় নাজিল করলে তাদের বুঝতে ও অনুসরণ করতে সহজ হবে না।
ইসলাম শুধু ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে ব্যাপক জাতীয় কল্যাণ বাধাগ্রস্ত হতে দেয়নি। বরং যাযাবর আরবদের স্থানীয় ভাষায় কোরআন নাজিল করে বিশ্বকল্যাণ নিশ্চিত করা হয়েছে।
ধর্ম প্রচারে শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অনস্বীকার্য। আমাদের প্রিয় রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ‘আফছাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। তাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবীজি (সা.)-এর সুন্নত। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ওয়া ইন্না মিনাল বায়ানি লা ছিহরুন’। অর্থাৎ কিছু বর্ণনায় রয়েছে জাদুর ছোঁয়া। আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলের হিদায়াতের জন্য হজরত মুসা (আ.)–এর প্রতি ওহি নাজিল করলেন; তাঁকে নবী ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করলেন; তাঁর ওপর তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ করলেন। তখন তিনি তাঁর ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে নবী ও রাসুল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন আরজ করলেন। কারণ তিনি ছিলেন বাগ্মী, শুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী এবং সুবক্তা, আর মুসা (আ.)-এর মুখে ছিল জড়তা। মুসা (আ.) কারণ হিসেবেও বলেছেন, ‘হুয়া আফছাহু মিন্নি।’ অর্থাৎ সে আমার অপেক্ষা বাকপটু। পবিত্র কোরআনে এই বর্ণনাটি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে: মুসা (আ.) বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কর্ম সহজ করে দিন। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আমার জন্য দিন একজন সাহায্যকারী আমার স্বজনদের মধ্য হতে; আমার ভাই হারুনকে; তাঁর দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাঁকে আমার কর্মের অংশীদার করুন, যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর; এবং আপনাকে স্মরণ করতে পারি অধিক; আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।’ (সূরা-২০ তহা, আয়াত: ২৫-৩৬, পারা: ১৬)।
প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের সঙ্গে স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য কোনো বিভেদ বা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে না। তাই মুসলিম নাগরিকেরা সব সময় মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। কিন্তু ইসলামের নামে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী জনমতের বিপরীতে অবস্থান করে, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে, ধর্মীয় চেতনার তোয়াক্কা না করে এ দেশের মানুষকে ভিনদেশি ভাষার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়। কিন্তু এ দেশের জনগণ তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাক্স্বাধীনতা ও নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য প্রাণ দেয় নিরস্ত্র ছাত্র–জনতা। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র আমরাই মাতৃভাষার জন্য রক্ত ও জীবন দিয়েছি। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের ‘ভাষাশহীদ দিবস’ এবং বর্তমানে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।
তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আল্লাহ তাআলা ভাষাশহীদসহ সব শহীদানের শাহাদাত কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁদের উচ্চমর্যাদায় আসীন করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি সাধন করুন। আমাদের বিশুদ্ধ মাতৃভাষার ব্যবহার ও এর মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি দাওয়াতের তৌফিক দান করুন।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

smusmangonee@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com