জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের বলেছেন, ১৯৯১ সাল থেকে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের জায়গায় দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারী শাসন চালু হয়েছে। দেশের পার্লামেন্ট সরকারি কর্মকা-কে বৈধতা দেয়ার একটা প্রসেস ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে বিরোধী দলের মতামতের কোনো মূল্য নেই। দেশে সুশাসনের অভাব আছে। এটা দিন দিন বাড়ছে।
একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের এই উপনেতা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জোটের রাজনীতি থেকে কেউই বেরিয়ে আসতে পারবে না। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে দুটি ধারা বা জোট রয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি একই ভাবধারার দল। যদি জাপা আওয়ামী লীগের সাথে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো রক্ষণশীলদের ভাঙন ধরাতে পারবে, তাদের জন্য ইলেকশনে জেতা অনেকটাই সহজ। তবে, জাপা যদি বিএনপিকে (জোট ) চয়েস করে তখন একটা রিস্ক এসে যায়। সেটা হলো বিএনপির সাথে জোট হলে যে পার্টিটা (জাপা-বিএনপি) শক্তিশালী হবে, যার নেতৃত্ব ভালো হবে তার মধ্যে একটা বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমরা যদি বিএনপির ভেতর (জোটে) চলে যাই তাহলে জাতীয় পার্টি নামে আর কোনো পার্টি থাকবে না, যদি বিএনপি শক্তিশালী পার্টি হিসেবে থাকে। আর বিএনপির যদি নেতৃত্বের ধস নামে, দুর্বল হয়ে যায়, বিএনপির মধ্যে জাতীয় পার্টি মার্জ (বিলীন) হবে না, বিএনপিই জাতীয় পার্টির মধ্যে মার্জ হবে। তবে সামনের পরিস্থিতি কী হয় এর ওপরই এটা নির্ভর করছে। জাতীয় পার্টিতে কোনো ভেদাভেদ নেই। সুশৃঙ্খলভাবে দল এগিয়ে যাচ্ছে। দলের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রথম বিকল্প দল হচ্ছে বিএনপি।
দ্বিতীয় বিকল্প হলো জাতীয় পার্টি। আমরা প্রথম বিকল্প হতে চাই। সরকার যেখানে আছে সেখানেই থাকবে, আমরা বিএনপির জায়গায় প্রথম বিকল্প হবো। এরপরে আমরা সরকারে যাবো, এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সাম্প্রতিক সময়ের বক্তৃতায় জাপা পরগাছা হয়ে থাকবে না বলে মন্তব্য করেছেন জি এম কাদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেককে বলতে শোনা যায় যে, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের বি টিম। আবার অনেক সময় অনেকে বলে যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া জাপার অস্তিত্ব থাকত না এবং ভবিষ্যতেও অস্তিত্ব থাকবে না। তার মানে তারা যা বলতে চায় সেটা হলো-জাপাকে পরাগাছা হিসেবে কোনো গাছের ওপর ভর করে থাকতে হয়।
সেটা মনে করি সঠিক তথ্য নয়। আমাদের প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মানুষের সাথে নিতে চায়। আমাদের যে শিকড় আছে, আমরা যে পরগাছা নই-এটা আমাদের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রমাণ করে গেছেন। উনি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি এর পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে বৈরী অবস্থা থাকা সত্ত্বেও পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে তা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। জাপা যে পরগাছা নয় এটা তিনি পরবর্তীতেও ধরে রেখেছিলেন আমৃত্যু। যখন তিনি মারা যান তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা। তার নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। অনেকে মনে করেছিল যে, এরশাদ সাহেব মারা গেলে হয়তো জাপা শেষ হয়ে যাবে বা দুর্বল হয়ে পড়বে। আল্লাহর রহমতে এখন দেখছি যে এরশাদ সাহেবের পরেও মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা আরো বাড়ছে জাপাকে নিয়ে।
সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টিকেই দেখতে চাচ্ছে উল্লেখ করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, জাতীয় পার্টির যারা নেতৃত্বে আছে তারা কখনোই পার্টিকে পরগাছা হতে দেবে না। কেউ যদি ষড়যন্ত্র করে, আমরা সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করব। এজন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত। এতে কোনো ঝুঁকি-বিপদ আপদেও আশঙ্কা থাকতে পারে- জেল জুলুমের ভয় থাকতে পারে। সরকারসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার কারণেই কি এই শঙ্কা? কোনো চাপ আসছে কি না কোনো মহল থেকে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরাসরি কোনো চাপ আসেনি। আমরা এখনো যা করছি সেটা হলো জনগণের সামনে সত্য তুলে ধরছি। সরকারের হয়তো এখনো ওই ধরনের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়নি যে, সরকারের বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি বিশ্বাস করি সত্যের একটা নিজস্ব শক্তি আছে। এখনকার অবস্থা থেকে মানুষ পরিত্রাণ চায়। আমরা মনে করি কোনো এক সময় গিয়ে সরকার বা আমাদের বিপক্ষ শক্তি আমাদের বাধাদানের চেষ্টা করতে পারে।
জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধীদল দল হিসেবে অভিহিত করা হয়, এই তকমা-দূর করার জন্যই কি সাম্প্রতিক সমালোচনামূলক বক্তব্য দিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, গৃহপালিত তকমা এটা নিশ্চিত খারাপ জিনিস। আমরা চাইবো না যে মানুষ আমাদের নিয়ে ভুল ধারণা করুক। তখন হয়তো কোনো কারণও ছিল। এখন আমি মনে করি যে কোনো কারণ নেই। ২০০৮-এর আগেও কোনো কারণ দেখিনি। সংসদীয় গণতন্ত্রের আমরা চর্চা করছি বা বলছি। আসলে এটা সংসদীয় গণতন্ত্র নয়। এটা কোনো গণতন্ত্রই নয়। তাই বলব, আমরা পাতানো খেলার বিরোধী দল বা গৃহপালিত বিরোধী দল, এগুলো বলার কোনো যুক্তি নেই। এটা কথার কথায় বলা।
এক প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি অতীতেও প্রতিটি বিষয়ে রাজপথে ছিল। বিএনপি যেভাবে ছিল আমরা তার কম ছিলাম না। অনেক সময় বিএনপি ছিল না-আমরা ছিলাম। আমরা সংসদে বলেছি, বাইরে এসে মানববন্ধন করেছি, র্যালি করেছি। সারা দেশে মিটিং করেছি। তবে হিংসাত্মক কর্মকা- আমরা কোনো দিনই করতাম না। আর এখন আমরা মনে করি, এটা জনগণও গ্রহণ করছে না। এটা কার্যকরও হচ্ছে না। ২০১৪-এ নির্বাচনের পরে তিন মাসের বেশি সময় ধরে বিএনপি দেশকে অচল করে দিয়েছিল বলা চলে। ঢাকাকে অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। অর্থনৈতিক কর্মকা- স্থবির হয়ে গিয়েছিল। তথাপি সরকার পরিবর্তন হয়নি। ফলে বিএনপি নিজেরাই এটা থেকে দূরে সরে এসেছে। ওই ধরনের আন্দোলনে আর কোনো কার্যকারিতা আছে বলে জনগণও বিশ্বাস করে না, সরকারও গ্রাহ্য করে না। সংসদের বাইরে এখন আর কেউ আন্দোলন সেইভাবে করছে না বা করার মতো পরিস্থিতি তাদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জোটের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, সবাই যখন জোটের মধ্যে যায় আমাদের কোনো না কোনো জোটে যেতেই হয় বা হবে। এটিই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ। যদি নির্বাচন সিস্টেম না পরিবর্তন করি, প্রভিন্সিয়াল ভোটিং সিস্টেম বা আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচন না করা হয় তাহলে আমাদের দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত টিকবে না। বহুদলীয় গণতন্ত্র টিকতে হলে আমাদের প্রবেন্সিয়াল ভোটিং সিস্টেমে যেতে হবে। যেখানে সবাই, যারা ১ শতাংশ ভোট পায় তারাও ১ শতাংশ সিট পার্লামেন্টে পাবে। সাধারণভাবে যেকোনো (কনস্টিটিউয়েন্সি) নির্বাচনীয় এলাকায় যদি ৩০-৪০ শতাংশ ভোট না থাকে পার্টি যতই শক্তিশালী হোক জিততে পারবে না। এ জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রবেন্সিয়াল ভোটিং সিস্টেমে (আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি) যাচ্ছে। যদি আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা করতে চাই তাহলে বর্তমান ভোটিং সিস্টেম থেকে সরে আসতে হবে। ভবিষ্যতে যেকোনো দল কোনো না কোনো জোট থেকে নির্বাচন করবে বলেই আমার বিশ্বাস। এর বাইরে উপায় নেই তাদের।
তার মানে জাতীয় পার্টি আগামীতেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে থেকেই নির্বাচন করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করা মহাজোটের সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, এটা এখনই আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। নির্বাচনের আগে সবদলই ঠিক করবে কোথায় কার সাথে নির্বাচন করলে ভালো হবে। আর আমরা আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচন করেছি কারণ, বাংলাদেশ শুধু নয় সারা পৃথিবীতে দুটো ধারার রাজনীতি চলে। একটাকে বলা হয় রক্ষণশীল বা রাইটিস্ট আর আরেকটাকে বলা হয় উদারপন্থী বা লেফটিস্ট। দুটো ধারাতেই সব ভাগ হয়। আমাদের দেশে তিনটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি মধ্যমপন্থী দল। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিশেষত্ব হলো মধ্যমপন্থী দল হলেও সবসময় লেফটিস্টদের (বামপন্থী) নিয়ে অ্যালায়েন্স (জোট) করে। বা তাদের সাথে থাকতে পছন্দ করে। আর যেহেতু লেফটিস্টরা অলরেডি আওয়ামী লীগের সাথেই ছিল, তাই মধ্যমপন্থীদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না এবং যারা লেফটিস্টদের পছন্দ করে না, রাইটিস্ট তাদেরকে নিয়েই বিএনপি হয়েছে। পরবর্তীতে যখন তাদের নেতা (জিয়াউর রহমান) মারা গেছেন, যখন দলের দুর্দিন তখন এরশাদ সাহেবের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে তখন তাদের (বিএনপি) বেশির ভাগ নেতাকর্মী জাতীয় পার্টিকে সমর্থন করেছে। সুতরাং জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি আদর্শগতভাবে একই। মধ্যপন্থী কিন্তু, রক্ষণশীল প্রকৃতির। আর আওয়ামী লীগ হলো মধ্যপন্থী কিন্তু উদারপন্থীদের নিয়ে সখ্য।