দখলের থাবর শিকার কর্ণফুল
পতেঙ্গার লালদিয়ার চরে চট্টগ্রাম বন্দরের হাজার কোটি টাকার ৫২ একর জমি দখলমুক্ত হয়েছে। তবে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের ধারক কর্ণফুলীর দুই তীরে হাজারো অবৈধ স্থাপনা এখনো অক্ষত থেকে গেছে। দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে দখলবাজদের থাবা। নদী দখল করে গড়ে উঠছে বড় বড় ভবনসহ হরেক স্থাপনা। রাঘব-বোয়ালদের বেপরোয়া দখলবাজীতে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী নদী।
তাতে চট্টগ্রাম বন্দরের মূল চ্যানেল সরু হয়ে গেছে। নদীর প্রস্থ ২০০ থেকে ২৫০ মিটার কমে কোন কোন অংশ খালের আকার ধারণ করেছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় কমছে গভীরতা। ফলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়েও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কর্ণফুলীকে দখল-দূষণের কবল থেকে রক্ষা করে গভীরতা বাড়াতে না পারলে নগরীতে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার চলমান পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সুফলও মিলবে না বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, দখলের কারণে নদীর ভৌগোলিক অবস্থান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কালুরঘাট থেকে কর্ণফুলীর মোহনা পর্যন্ত নদীর গড় প্রস্থ ছিল ৬০০ থেকে ৯০০ মিটার। এখন তা ৫০ থেকে ২৫০মিটার পর্যন্ত কমে গেছে। প্রস্থ কমে যাওয়ায় নদীর গভীরতাও কমে গেছে। কর্ণফুলীকে ঘিরে চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এবং ব্যবসা শুরু হয়। কিন্তু এখন এই নদী নিজেই ব্যবসার উপাদানে পরিনত হয়েছে। আর তাতেই বিপর্যয় নেমে আসছে। তিনি বলেন, কর্ণফুলীকে দখল-দূষণের কবল থেকে রক্ষা করে নদীর গভীরতা বাড়ানো না গেলে পানিবদ্ধতা প্রকল্পেরও সুফল মিলবে না। কারণ নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টি আর জোয়ারে নগরী প্লাবিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, নদী তীরে অবৈধ স্থাপনা ২ হাজার ১১২টি। তবে গত কয়েক বছরে অবৈধ স্থাপনা আরও বেড়েছে। অব্যাহত দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, চর জেগে উঠাসহ নানা করণে কর্ণফুলীর প্রস্থ কমে আসছে। সদরঘাট থেকে বালুরঘাট পর্যন্ত নদীর দুই তীরে হাজার হাজার স্থাপনা। রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রভাবশালীদের এসব স্থাপনা কর্ণফুলী নদীকে চেপে ধরেছে। আদালতের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে নদী তীরে জমি ইজারা দেওয়া হচ্ছে। ইজারা ছাড়াই অনেক এলাকায় স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
আদালতের নির্দেশে বিগত ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে টানা পাঁচ দিনের অভিযানে নগরীর সদরঘাট থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত অংশে ৩৮০টি স্থাপনা গুঁড়িয়ে ১০ একর জমি দখলমুক্ত করা হয়েছিল। তবে অভিযান থেমে যাওয়ায় ওই জমি ফের দখলবাজদের কব্জায় চলে যায়।
এদিকে আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ৫২ একর জমি দখলমুক্ত করে। তার আগে একই এলাকায় আরো ২৬ একর জমি দখলমুক্ত করা হয়। কিন্তু নদী তীরে বিশেষ করে বারিকবিল্ডিং থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত অংশে অবশিষ্ট অবৈধ স্থাপনা কখন উচ্ছেদ করা হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। এ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এবং জেলা প্রশাসনের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি।
২০১০ সালে কর্ণফুলী নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে নদীর সীমানা নির্ধারণ, দখল, ভরাট ও নদীতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। এ প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এ লক্ষ্যে গঠিত ১৬ সদস্যের কমিটি ২০১৬ সালের ১৮ জুন আরএস ও বিএস রেকর্ড অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর বর্তমান অবস্থান ও দখলদারদের চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করে। এরপর ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিন সময় বেঁধে দিয়ে আদেশ দেন। এই প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে অভিযান শুরু হলেও তা থেমে যায়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী লালদিয়ার চরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। আগেই জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সদরঘাট থেকে বারিকবিল্ডিং অংশে উচ্ছেদ করা হয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন কোথাও অবৈধ স্থাপনা হবে তখন সেটি উচ্ছেদ করা হবে। বন্দরের এস্টেট বিভাগের সহকারী ম্যানেজার জিল্লুর রহমান বলেন, সদরঘাট থেকে কর্ণফুলী হয়ে কালুরঘাট পর্যন্ত অংশে জেলা প্রশাসনের জমি। সেখানে উচ্ছেদ অভিযান তারাই পরিচালনা করবে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, আমি চট্টগ্রামে নতুন। এই বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।