আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে জনশক্তি রফতানিকারকদের জমাকৃত হাজার হাজার মার্কিন ডলার উধাও হওয়ায় সউদী শ্রমবাজারে ‘নতুন ভিসা ইস্যু’ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেক নতুন ভিসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার মেয়াদোত্তর্ণী হয়ে যাচ্ছে। আরব ন্যাশনাল ব্যাংকে বৈধ পন্থায় ডলার জমা দেয়ার প্রক্রিয়া চালু না হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সউদীর শ্রমবাজার ধরে রাখার স্বার্থে বৈধ পথে সউদী ব্যাংকে ডলার প্রেরণের প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে গোটা বিশ্বঅর্থনীতি লন্ডভন্ড। মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রভাবশালী দেশগুলোতে কমে এসেছে কর্মক্ষেত্র। বিশ্বের দেশে দেশে চাকরি হারিয়েছেন লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক। সে প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যেও। এতে করে সউদী গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীরা কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া নিয়ে ফের অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছেন। বিদেশের কর্মস্থলে ফিরতে না পেরে চোখের পানি ফেলছেন লাখো শ্রামিক।
জানতে চাইলে জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের শ্রম সচিব জানান, সউদী আরবে প্রচুর বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা রয়েছে। সউদী সরকারের মুছানেদ সিস্টেমে গত এক মাস যাবত যান্ত্রিক ত্রুটির দরুন জনশক্তি রফতানির কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ২০১৯ সালে সউদীতে কর্মরত প্রবাসীরা ৩ লক্ষ ৯৯ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। অথচ ২০২০ সালে এর পরিমাণ মাত্র ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মাসের প্রথম সপ্তাহের পর সউদীস্থ আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশি বিপুল সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জমাকৃত মার্কিন ডলার উধাও হওয়ায় নতুন ভিসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
গালফ উপসাগরের তীরে আরব দেশগুলোতে প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করে, যাদের বেশিরভাগ এশিয়ান। এমনিতেই এয়ারলাইন্সগুলো সিন্ডিকেট করে বিমানের টিকিটের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি করায় কর্মীরা টিকিট কিনতে গলদঘর্ম। করোনাকালে অভিবাসন ব্যয়ের অর্থ যোগাতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের হিমসিম খেতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালে চাকরি হারিয়ে বিদেশ প্রত্যাগত এবং বিদেশ গমনেচ্ছুদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আড়াইশ কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে বরাদ্দ দিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে প্রবাসী কর্মীদের সাবলম্বী করতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ৯০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। ঋণ বিতরণে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে এখনো ডিজিটাল সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিদেশ প্রত্যাগতরা অসহায় কর্মী ঋণ পেতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
বৈধ পথে সউদী ব্যাংকগুলোতে ডলার প্রেরণের সুযোগ না থাকায় অনেকেই নানাভাবে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আরব ন্যাশনাল ব্যাংকে অর্থ জমা করে আসছিল। ব্যাংকে জমাকৃত ডলারের বৈধ ডকুমেন্ট হাতে না থাকায় এসব উধাও হওয়ায় অর্থ আদৌ ফেরত পাবে কী না সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফকিরাপুলের জি-নেট টাওয়ারের একজন জনশক্তি রফতানিকারক এ তথ্য জানান। ঐ জনশক্তি রফতানিকারক বলেন, সউদীতে অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চতকরণ এবং সউদী নাগরিকদের বেশি বেশি কর্মসংস্থানে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে আগামী জুন মাস থেকে কাফেলা সিস্টেম বাতিল করতে যাচ্ছে দেশটির সরকার। চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে কোনো সউদী নাগরিকের অভিবাসী কর্মী নিয়োগ করতে হলে সরাসরি বিদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি বা কোনো ব্যক্তির কাছে ওকালা বিক্রি করতে পারবে না। কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র সউদী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভাল অনুমোদন দিবে। এ প্রক্রিয়া কার্যকরী হলে অভিবাসী কর্মীদের পালিয়ে পালিয়ে অন্যত্র কাজ করতে হবে না।
সউদী মুছানেদ সার্ভার ত্রুটির দরুন কর্মীদের মোফার ফি পরিশোধ ও মেডিক্যাল সিল্প উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে সউদী গমনেচ্ছু হাজার হাজার কর্মী মাঝে চরম হতাশায় ভুগছেন। বায়রার একজন সাবেক যুগ্ম মহাসচিব জানান, আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে এজেন্সিগুলোর ডলার উধাও হওয়ায় নতুন এই সৃষ্ট সঙ্কটের দরুন দশ থেকে বিশ হাজার সউদী গমনেচ্ছু কর্মী বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, আমার এজেন্সি’র প্রথমে ৩৭৫ মার্কিন ডলার কেটে নিয়েছে। পরে আরো ৫শ’ মার্কিন ডলার আরব ন্যাশনাল ব্যাংকে জমা করা হলে তাও কেটে নেয়া হয়েছে। এতে নতুন ভিসা ইস্যুর কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি সউদীর বৃহত্তম বাজার রক্ষার স্বার্থে অনতিবিলম্বে আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে উধাও হওয়া ডলার উদ্ধার এবং নতুন ভিসার কার্যক্রম চালু করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আশু হস্তক্ষেপ কামান করেন। এদিকে, সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ এখনো চোখে পড়েনি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব না হলে সউদী শ্রমবাজারে ধস নেমে আসতে পারে। একাধিক বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির স্বত্বাধিকারী এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমদ মনিরুছ সালেহীন গত মঙ্গলবার তার দপ্তরে বলেন, আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশি এজেন্সিগুলোর মার্কিন ডলার উধাও হওয়ার বিষয়টি আমাকে কেউ অবহিত করেনি। সউদী ব্যাংক থেকে ডলার উধাও এবং নতুন ভিসার কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে লিখিত আবেদন পেলেই কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া হবে।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির মাঝেও রাজকীয় সউদী সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গত অক্টোবর থেকে বাংলাদেশি কর্মী নেয়া শুরু করেছে। বিএমইটি’র পরিচালক (ইমিগ্রেশন) মো. রেজাউল করিম জানান, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সউদীসহ বিভিন্ন দেশে ৪৯ হাজার ৫৫২ জন নারী-পুরুষ কর্মী চাকরি নিয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু সউদীতে গেছে ৩৮ হাজার ৩৯৬ জন কর্মী। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে ২৩ হাজার ৩৬২ জন নারী-পুরুষ কর্মী সউদীতে চাকরি লাভ করেছে। গত জানুয়ারি মাসে সউদীতে গিয়েছে ২৬ হাজার ৬৪৭ জন কর্মী।
করোনা মহামারি কিছুটা শিথিল হওয়ায় সউদী আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, সিঙ্গাপুর ও জর্ডানে কর্মী যাওয়া শুরু হওয়ায় জনশক্তি রফতানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভ্রাতৃ-প্রতীম সউদীর আরবের সাথে বাংলাদেশের চমৎকার ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সর্ম্পক বিরাজ করছে। দেশটি বর্তমানে পনেরো লক্ষ বাংলাদেশি নারী-পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪.০২ বিলিয়ন ডলার, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এই রেকর্ড গড়তে বড় ভূমিকা রেখেছে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৩ দিনে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৪৯ কোটি ডলার। গত বছর একই সময়ে রেমিট্যান্স আসে ১২৪ কোটি ডলার।
বায়রার সাবেক নেতা নাসির উদ্দিন সিরাজ বলেন, সউদী আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জমাকৃত ডলার উধাও হওয়ার ঘটনায় রাজকীয় সউদী সরকারের কোনো দোষ নেই। এটা হ্যাকারে মাধ্যমে জমাকৃত ডলার উধাও হয়েছে। বায়রার সাবেক যুগ্মমহাসচিব মিজানুর রহমান আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বিভিন্ন এজেন্সির ডলার উধাও হওয়ায় সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা আজ দিশেহারা। একমাত্র সরকারের উদ্যোগেই আমাদের এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। বিগত দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে সউদী সরকার নতুন করে তাদের অনলাইন সিস্টেম টিকে আরো গতিশীল ও বাস্তব সম্মত করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু এই কাজটি আমাদের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। এখন অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি ভিসা ফি পরিশোধ করতে না পারায় বহু ভিসা কার্যক্রম বন্ধ হয়েগেছে। এখানে বিপদ হয়েছে কর্মী প্রেরণের চাহিদাপত্র পাবার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মী প্রেরণ করতে হয়। তাছাড়া মেডিক্যাল এর মেয়াদ ও চলে যাচ্ছে।
হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার এর স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সাবেক অর্থ সচিব ফখরুল ইসলাম রাতে জানান, তার এজেন্সির ৭৫০ মার্কিন ডলার আরব ন্যাশনাল ব্যাংক কেটে নিয়ে গেছে। সউদী ভিসার বিভিন্ন ফি পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে ডলার পাঠানোর কোনো প্রক্রিয়া চালু করা হয়নি। বাধ্য হয়েই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা নানা পথে সউদী ব্যাংকে ডলার জমা করেন। সৃষ্ট সঙ্কটের দরুন সউদীর শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
তৈয়্যবা কনসালটেন্সি, আল ফুরসান কনসালটেন্সি, সউদী বাংলা কনসালটেন্সি, সী-সেল বাংলাদেশ লিমিটেড, শাহেনা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর জমাকৃত ডলার কেটে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সী-সেল বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. মেসবাহ উদ্দিন বলেন, সউদী ব্যাংক তার ১৮ ডলার কেটে নিয়ে গেছে। নতুন ভিসার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অনেকের ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। তিনি সৃষ্ট সঙ্কট দ্রুত নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। রিক্রুটিং এজেন্সি সানবিম ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো. সালামত উল্লাহ সউদী ব্যাংক থেকে ডলার উধাও প্রসঙ্গে বলেন, আমি চোরের খপ্পরে পরিনি; তবে কখন পরে যাই বলাও যায় না। আরব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ডলার চুরি আর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির চেয়ে কম নয়। হাবের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব রুহুল আমিন মিন্টু বলেন, সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সবচেয়ে বেশি কর্মী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। কতিপয় এজেন্সি সিন্ডিকেট করে এয়ারলাইন্সের টিকিট আট থেকে দশগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে।