সব ধরনের পেমেন্ট সিস্টেম কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইন ২০২১’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এ আইন অনুযায়ী পেমেন্ট তথা পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারীর কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ আইনে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মন্ত্রীরা বৈঠকে যোগ দেন।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে এ অনুমোদনের কথা জানান। তিনি বলেন, এতদিন পেমেন্ট সিস্টেম-সংক্রান্ত পৃথক কোনো আইন ছিল না। এসব কার্যক্রম কন্ট্রাক্ট আইন অনুযায়ী চলত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইলেকট্রনিক লেনদেন বিস্তারের ফলে গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকের পাশাপাশি অব্যাংক সেবা পরিশোধকারীদের তত্ত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের আইনি কাঠামোতে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তাই এ আইনটি আনা হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে দেশে কার্যরত সব পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারীর কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারের অধীনে তৈরি করা রেগুলেশন দ্বারা দেশের পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতো। রেগুলেশনের বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার ও দ- সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইন প্রণয়নের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নতুন নতুন পেমেন্ট সেবা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় ২০১৫ সাল থেকে পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইনের খসড়া তৈরি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস আইন-২০২১-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আইনের খসড়ায় বলা হয়, মূল ব্যাংকিং সেবার বাইরে অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসায় আগ্রহী ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ সেবা প্রদানের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত পৃথক অনুমোদন নিতে হবে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানও অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত পরিমাণে, হারে ও পন্থায় মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে অনেক ধরনের লেনদেন হচ্ছে। মূল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তর, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডসহ বিকাশ, নগদ, রকেট, বিভিন্ন ব্যাংকের ই-ওয়ালেট, ইন্টারনেন্ট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মুদ্রা, ইলেকট্রনিকভাবে তহবিল স্থানান্তর, চেক ইলেকট্রনিকভাবে উপস্থাপন, ডিজিটাল মুদ্রা, ট্যাংকেটেড চেক, ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট, সরকারি সিকিউরিটিজ সেটেলমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ, অর্থ গ্রহণ ও গ্রাহকের অর্থ চাহিদা নিষ্পত্তি হচ্ছে। আর এসব পদ্ধতি ব্যবহার করছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট। এদের কার্যক্রম তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো এবং গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এ আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। আইনের খসড়ায় অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ গঠনে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কোনো ঋণখেলাপি অর্থ লেনদেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না এবং প্রতিষ্ঠানের কোনো উদ্যোক্তা পরিচালকের শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে না। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
খসড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিষয়ে বলা হয়, দেশে কার্যরত সব পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারীর কার্যক্রম পরিচালনায় অনুমতি প্রদান, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা তাদের নিযুক্ত এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যেকোনো বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করতে পারবে। পাশাপাশি এ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ওই নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে। এসব প্রতিষ্ঠানের যেকোনো কার্যালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করতে পারবেন। পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেকোনো তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকবে। এ আইনের অধীনে একটি পরিশোধ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির প্রধান হবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর। এ কমিটির কার্যপরিধি, গঠন বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পরিশোধ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সমন্বয় এবং পরিশোধ কার্যক্রমে নতুনত্ব আনয়ন, পরিশোধ ব্যবস্থার ঝুঁকি হ্রাস ও নিরাপত্তা বিধান-সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দেবে। খসড়া আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, বিধিবিধান লঙ্ঘন করে কোনো প্রতিষ্ঠান লেনদেন ব্যবসা পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপসহ সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত ও প্রত্যাহার করা হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স না নিয়ে বা কোনো বিধি লঙ্ঘনের দায়ে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পর কেউ এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এর পরও একই কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে প্রতিদিনের জন্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।
এছাড়া নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অসহযোগিতা করা, কোম্পানির হিসাব, বহি বা নথিপত্র নষ্ট, ধ্বংস, পরিবর্তন, গোপন বা ভুলভাবে উপস্থাপন এবং অসাধু উদ্দেশ্যে পরিশোধের ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ১ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
খসড়া আইন অনুযায়ী, কোনো পেমেন্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্রাহক বা জনস্বার্থবিরোধী কোনো কার্যক্রমে লিপ্ত হলে সেটি অবসায়ন করতে হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তৃতীয় কোনো পক্ষের আবেদনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন হবে না। আর আদালত থেকে অবসায়ন কার্যক্রম জারি করা হলে ওই প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের সঙ্গে কোনো লেনদেন করতে পারবে না। গ্রাহকের দায়দেনা প্রশাসকের ওপর বর্তাবে। তবে অবসায়নকালে গ্রাহককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এদিকে ‘সরকারি ঋণ আইন-২০২১’-এর খসড়াও নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা বলে জানিয়েছেন খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), ইনভেস্টর ফাইন্যান্সিং, জি-টু-জি (সরকার টু সরকার) ব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন এ আইন হচ্ছে।