শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার জন্য ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। গতকাল শনিবার (২০ মার্চ) দুপুর ১২টার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব ইমরুল কায়েস রানা জানিয়েছেন, বেলা সাড়ে ১১ টায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। তাদের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যকার সমঝোতা স্মারক সই হয়। বৈঠক শেষে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভিজিটর বইয়ে স্বাক্ষর করেন এবং কার্যালয় ত্যাগ করেন।
এর আগে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসলে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় কিছুক্ষণের জন্য তারা একান্তে বৈঠক করেন। এরপর দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শুরু হয়। এর আগে শুক্রবার (১৯ মার্চ) দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই তার এ সফর। এদিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনারও প্রদান করা হয়।
দিনের শুরুতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার বেলা ১১টায় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন, দর্শনার্থী বইতে স্বাক্ষর করেন এবং সেখানে একটি গাছের চারা রোপণ করেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বিকেল ৩টায় হোটেল সোনারগাঁওয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে মহিন্দা রাজাপাকসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী বিকেল সাড়ে ৪টায় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গ্র্যান্ড বল রুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নৈশভোজে যোগ দেন। শনিবারের সফরসূচি অনুযায়ী তিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে বিকেল ৫টায় বঙ্গভবনের ক্রেডিশিয়াল হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তিনি সেখানে দর্শনার্থীর বইতে স্বাক্ষর করবেন।
‘বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ’: বাংলাদেশকে এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় উল্লেখ করে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলা নামের জনপথ থেকে আমাদের দেশে প্রথম অভিবাসী পৌঁছায় প্রায় দুই হাজার বছর আগে। আর বাংলার সঙ্গে সিংহলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল ঢাকায় এসেছেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে চলমান ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার তৃতীয় দিনে সম্মানিত অতিথির বক্তব্য রাখেন মাহিন্দা রাজাপাকসে।
শ্রীলংকা বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা বিভিন্ন আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে। আমরা পরস্পরকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে থাকি। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। সবসময়ই বাংলাদেশের পাশে থেকেছেন তিনি। আমিও চেষ্টা করি সেই বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতে। বাংলাদেশের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের যোগদান তার নিজের এবং শ্রীলংকার জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই প্রতিফলন। দুই দেশের জনগণের মধ্যকার এ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরো সুদৃঢ় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠুক। বাংলাদেশের একটি মানুষও ক্ষুধার্ত থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না, প্রতিটি মানুষের ঘরে আমরা আলো জ্বালব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সবদিকে বাংলাদেশের মানুষ যেন উন্নত, সমৃদ্ধ জীবন পায়, যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, যা তিনি সব সময়ই বলতেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, জাতির পিতার এই ১০১তম জন্মদিন আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা সেই প্রতিজ্ঞা নিই, জাতির পিতা যেই স্বপ্ন রেখে গেছেন, সেই স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করব। বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সোনার বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হতে পেরেছি। কাজেই এই বাংলাদেশে আজ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা সরকারে থেকে উদযাপন করার সুযোগটা পেয়েছি বাংলাদেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলাম বলে। তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা অর্জনে তাদের পূর্বসূরিদের সীমাহীন ত্যাগের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে উল্লেখ করে মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন ব্যক্তি যিনি তার পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন। এজন্য তিনি সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন ১৯৭১ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যা ঘটেছে, তা আমি অনুভব করতে পারি। ওই দিন দেশবাসী স্বাধীনতার জনককে হারান। সঙ্গে সঙ্গে কন্যারা হারান তার পিতা-মাতা ও ভাইদের।
শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে নবগঠিত বাংলাদেশের সঙ্গে যারা প্রথমে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল শ্রীলংকা তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে দুই দেশের মধ্যে মেরিটাইম, শিপিং ও বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। বঙ্গোপসাগরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্লু ইকোনমির প্রস্তাব প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে আসছে আমাদের মেরিটাইমের বিষয়ে। বাংলাদেশকে এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শ্রীলংকা বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে পাশে থেকে কাজ করবে।