নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত শিক্ষাবর্ষে নয় মাসের বেশি সময় বন্ধ ছিল দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের শুরুতে সংক্রমণ কমে আসায় আগামী মে মাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসে। কিন্তু গত মার্চের প্রথমেই দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সংক্রমণের হার কমাতে সরকার ১৪-২১ এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে। এর পরও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় ঈদের পর শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়ার বিষয়টি আবারো অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে গত বছরের মতো চলতি শিক্ষাবর্ষও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এক বছরের অধিক সময় পার হলেও শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি কাটাতে কোনো কার্যকর পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি। অন্যদিকে গতি হারিয়েছে অনলাইন ও দূরশিক্ষণ পাঠদান।
দেশে গত বছরের ৮ মার্চ কভিড-১৯ আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। প্রথম শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম কভিডে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পরই গত বছরের ১৬ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে সাধারণ ছুটি ও লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। তবে করোনার সংক্রমণ কমে গেলে গত ডিসেম্বর-জানুয়ারি থেকেই শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবি উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেয় সরকার। গত ৩০ মার্চ থেকে ৬০ দিন শ্রেণীকক্ষে ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮০ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের পর সেটিও ভেস্তে গেছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। যদিও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি আবারো অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবেÍএমন ঘোষণায় এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়েছিল শিক্ষা খাতে। কিন্তু সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতিতে অন্যান্য খাতের মতো ফের অনিশ্চয়তার মুখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। মে মাসের শেষের দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা ছিল। এপ্রিলে করোনা সংক্রমণের হারে নজর রেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে অনলাইন ও টেলিভিশনে পাঠদান সক্রিয়ভাবে প্রচার ও সচল রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে প্রাথমিকের অনলাইন ও টেলিভিশনভিত্তিক পাঠদান সম্প্রচার কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। গত শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয় অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে। গত বছরের মতো এবারো ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট ও নির্ধারিত কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। গত ২০ মার্চ থেকে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। যদিও চলতি মাসের লকডাউন ঘোষণায় স্থগিত রাখা হয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রমও। সশরীরে পাঠদান চালু হওয়ার পরিকল্পনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের অনলাইন এবং দূরশিক্ষণের পাঠদান অনেকটাই গতি হারিয়েছে। অনলাইন ও টেলিভিশনে নিয়মিত পাঠদান সম্প্রচার হচ্ছে না। গত বছরের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার শুরু হয়। যদিও সেসব ক্লাস শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। শহরের প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও মফস্বল ও শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এখনো পড়ালেখার বাইরে রয়েছে। ফলে গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণে (সংসদ টিভি, রেডিও, অনলাইন ও মোবাইল ফোন) ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ধরনের অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসেনি। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে কোথাও কোথাও পাঠদান চালু থাকলেও বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের পরীক্ষা কার্যক্রম। বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্কের হিসাবে গত তিন মাসে উচ্চশিক্ষায় অনলাইন পাঠদান কমেছে ৩০-৪০ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, গত বছর এ সময়ে আমরা যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম, এ বছর একই সময়ে সেটি আরো খারাপভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিচ্ছি না। বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষা খাতকে সচল রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে আগামী মে মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের এ বড় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখনো কোনো ধরনের পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। সময়ে সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘোষণা এলেও কার্যকর কোনো পরিকল্পনা নিতে দেখা যাচ্ছে না নীতিনির্ধারকদের।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সময়ে সময়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত দেয়ার কারণে এসব বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আগে থেকে প্রস্তুত থাকে না। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসছে পরীক্ষা না নেয়ার। অর্থাৎ সমন্বিতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি অনেকদিন থাকবে, সেটি বিবেচনায় নিয়েই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেয়া উচিত।