চলতি বছরটিও মহামারি আক্রান্ত, ফলে মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ। এবছর রাজনীতি, চলচ্চিত্র, শিক্ষা, সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেককে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বিনোদন অঙ্গনের মধ্যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী, নায়ক ওয়াসিম, অভিনেতা এস এম মহসীন, সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক প্রমুখ। গত শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) রাত ১২টা ২০মিনিটে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ঢাকাই সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত এক সময়কার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও নির্মাতা সারাহ বেগম কবরী। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ১৩ দিনের মাথায় তিনি চলে গেলেন।
গত ৫ এপ্রিল কবরীর করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এলে তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দরকার হয় আইসিইউর। কুর্মিটোলা হাসপাতালে আইসিইউ খালি না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহযোগিতায় গত ৮ এপ্রিল তাকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আইসিইউতে প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দেশের জনপ্রিয় এ অভিনেত্রী।
রাজধানীর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় কিংবদন্তি অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরীকে। দাফনের আগে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গার্ড অব অনার দেয়া হয় তাকে। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ার শুরুর ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘দেবদাস’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘দীপ নেভে নাই’-এর মতো দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কবরী।
২০০৬ সালে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’ মুক্তি পায়। ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন কবরী। এরপর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।
১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন কবরী। তার আসল নাম ছিল মিনা পাল। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও সবশেষে সিনেমায়। কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা।
নায়ক ওয়াসিম: গত শনিবার (১৭ এপ্রিল) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান ঢাকাই সিনেমার এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। কয়েকদিন আগে অসুস্থ হওয়ার পর ওয়াসিমকে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার উন্নতি হলে সেখান থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে শনিবার শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল। গুলশানের আজাদ মসজিদে প্রথম ও বনানীতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে তাকে। ১৯৭২ সালে ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’ সিনেমার সহকারী পরিচালক হিসেবে ঢাকাই সিনেমায় ওয়াসিমের অভিষেক। নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় মহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ সিনেমার মাধ্যমে। এক সময় বাণিজ্যিক সিনেমায় অপরিহার্য নায়ক হয়ে ওঠেন তিনি।
ওয়াসিম অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ছন্দ হারিয়ে গেলো’, ‘রাতের পর দিন’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘দি রেইন’, ‘রাজদুলারী’, ‘বাহাদুর, ‘মানসী’, ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘বেদ্বীন’, ‘ঈমান’, ‘লাল মেম সাহেব’ ইত্যাদি।
অভিনেতা এস এম মহসীন: ১৮ এপ্রিল (রোববার) সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা এস এম মহসীন। এস এম মহসীন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল। এরপর ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ায় এই অভিনেতাকে স্থানান্তর করা হয় বারডেম হাসপাতালে।
উল্লেখ্য, এস এম মহসীন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ম ও টেলিভিশন অভিনেতা ছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এবং জাতীয় থিয়েটারের প্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত এই অভিনেতা। আতিকুল হক চৌধুরী পরিচালিত ‘রক্তে ভেজা’ ও ‘কবর’ এবং মুনীর চৌধুরী পরিচালিত ‘চিঠি’ নাটকে অভিনয় করেছেন এস এম মহসীন। ‘পদক্ষেপ’ নাটকের মধ্য দিয়ে রেডিও নাটকে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো লাভ করেন। পেয়েছেন শিল্পকলা পদকও। অভিনয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ: গত মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) সকাল ৯টার দিকে মারা যান দেশের গুণী সুরকার ও সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ১১ এপ্রিল থেকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন বরেণ্য এই সুরকার। তারও আগে মার্চের শেষ সপ্তাহে সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হন ফরিদ আহমেদ। অবস্থার খানিক অবনতি হলে ২৫ মার্চ রাতে তাকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফরিদ আহমেদের করা গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘ইত্যাদি’র টাইটেল সং ‘কেউ কেউ অবিরাম চুপি’, কুমার বিশ্বজিতের ‘মনেরই রাগ অনুরাগ’,‘ আমি তোরই সাথে ভাসতে পারি মরণ খেয়ায় একসাথে’, রুনা লায়লার গাওয়া ‘ফেরারী সাইরেন’, রুনা সাবিনার কন্ঠে ‘দলছুট প্রজাপতি’, চ্যানেল আইয়ে ‘আজ জন্মদিন’, ক্ষুদে গান রাজ’র ‘থিম সং’, ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’র থিম সং, সেরা কণ্ঠ’র থিম সং প্রভৃতি।
অনেক নাটক, টেলিফিল্ম সিনেমার জন্য গান বানিয়েও সফল হয়েছেন ফরিদ আহমেদ। গানের পাশাপাশি সংগীত সংশ্লিষ্টদের বিপদে-আপদে খোঁজখবর আর সহায়তা করার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার মৃত্যুকে দেশের সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক: গত রোববার (১১ এপ্রিল) ভোর সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দেশের নন্দিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক।
করোনায় আক্রান্ত হলেও সুস্থ হয়েছিলেন মিতা হক। করোনা নেগেটিভ আসার পর ৯ এপ্রিল তাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ১০ এপ্রিল (শনিবার) সকালের দিকে হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। এরপর আবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে গত ২৫ মার্চ মিতা হকের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। শুরুতে বাসাতে আইসোলেশনে থাকলেও ৩১ মার্চ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মিতা হক গত ৫ বছর ধরে কিডনি রোগেও ভুগছিলেন। নিয়মিত ডায়লাইসিস নিয়ে ভালো ছিলেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানসিক এবং শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। করোনা থেকে সেরে উঠলেও হার্ট অ্যাটাকের কাছ হার মানতে হয় তাকে। মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালে। তিনি প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা খালেদ খানের স্ত্রী। তার চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক। মেয়ে জয়িতাও রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী।
কেরানীগঞ্জে জানাজা শেষে বাবা-মায়ের কবরের পাশে শায়িত করা হয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হককে। এর আগে তার মরদেহ ছায়ানট প্রাঙ্গণে নেয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকে। ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় মিতা হকের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’। সংগীতায়োজনে ছিলেন সুজেয় শ্যাম। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ২০০টি রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তার প্রায় বিশটি অ্যালবামের বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। ‘সুরতীর্থ’ নামে একটি গানের স্কুলও রয়েছে তার। মিতা হকের বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। তার মোট ২৪টি একক অ্যালবাম রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি ভারত থেকে ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে।
সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার মিতা হককে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়াও শিল্পকলা পদক, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র পুরস্কার, চ্যানেল আই রবীন্দ্র মেলা পুরস্কার এবং ভারত থেকে অনেক সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তবে মানুষের ভালোবাসাকে জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার বলে অবহিত করতেন এই কণ্ঠশিল্পী।