রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৬ অপরাহ্ন

মানুষ কাজ হারাবে, বাড়ছে আয়বৈষম্য 

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২১ এপ্রিল, ২০২১

একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

করোনার আগেও আয়বৈষম্য ছিল। এখন করোনার দু’দফা আঘাতে মানুষ কর্মহীন হচ্ছে। ফলে নতুন করে আয়বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করে তাদের অবস্থা নাজুক। যার ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার কারণে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে সরকারের উচিত হবে বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকারমূলক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো।
নিচে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা বিশ্বে অচল অবস্থা চলছে। অর্থনীতিতে এর অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে মনে করেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতিতে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখন তো বড় রকমের দুর্যোগ চলছে। করোনার প্রথম ধাক্কার রেশ এখনো কাটেনি। ফলে দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় মাত্রায় অভিঘাত আসবেই। মানুষ কর্মসংস্থান হারাচ্ছে নতুন করে। সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছর নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। নতুন করে কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকাররা অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করে তাদের অবস্থা নাজুক। যার ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আমরা ২০১৯ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচের লোকের হার ২০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম। অনেকেই বলছে এটা কারো মতে ৩০ শতাংশ আবার কারো মতে ৪০ শতাংশ এখন। বিশ্বব্যাংক গত সোমবার তাদের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতেও তারা বলেছে এটা এখন ৩০ শতাংশ। ফলে দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। করোনার এই আঘাত ছাড়াও আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই ক্রমান্বয়ে আয়বৈষম্য বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আয়বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাবে। কারণ মানুষ কর্ম হারাচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। যারা উচ্চ আয়ের মানুষ আছে এই করোনার দ্বিতীয় ধাক্কাতে তাদের যে ক্ষতি, নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে।
দ্বিতীয় ধাক্কার কারণে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ বিনিয়োগ আসবে না। রফতানি বাড়বে না। উৎপাদনও ব্যাহত হবে। যদিও কারখানা ও গার্মেন্ট খোলা রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক ও লোকজনের আসা-যাওয়ার অসুবিধা আছে। যেহেতু গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যারা গ্রামে চলে গেছে, তারা তো ফিরতে পারবে না। কাজেই অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তো হবেই। শহরের চেয়ে বোধ হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে এটা নির্ভর করবে আবহাওয়ার ওপরে। এখন কৃষি খাতের পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ না। লকডাউন হলেও গ্রামের মানুষ কাজ করে। গ্রামের অর্থনীতি আপেক্ষিকভাবে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমার কাছে মনে হয় না।
প্রশ্ন: করোনা দ্বিতীয় ধাক্কায় বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : করোনা মহামারীর প্রকোপ যদি না কমে তাহলে তো কর্মসংস্থান হবে না। এটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর কর্মসংস্থান না হলে শুধু সরকারি বিনিয়োগ পদক্ষেপে তো দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতি যে ব্যাহত হয়েছে তা পূরণ করা কঠিন হবে। তারপরও চেষ্টা করতে হবে। ফলে মূল চ্যালেঞ্জ হলো কিভাবে আমরা করোনার এই প্রকোপকে উপশম করতে পারি।
এগুলো থেকে উত্তরণ খুব সহজ নয়। দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেয়ার যেসব কর্মসূচি চালু রয়েছে সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষুদ্র কুটির ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এগুলোতে সরকার চেষ্টা করছে। তবে বিতরণের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য প্রথম দফায় ঘোষিত প্রণোদনার বড় অংশই বিতরণ এখনো হয়নি। বিতরণ না হওয়ার কারণে সেটার মেয়াদ এখন আবার জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রশ্ন: রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির মধ্যে আসছে নতুন অর্থবছরের বাজেট। এ ক্ষেত্রে বাজেট তৈরিতে সরকারের পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপনার পরামর্শ?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : রাজস্ব আহরণ আমাদের দেশে সব সময় কম ছিল; বাজেটে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটার জিডিপি হার নেপালের চেয়েও কম। আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। এতে বাজেটে হয়তো ঘাটতি বাড়বে। আমার মতে, এই পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারের উচিত হবে বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকারমূলক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো। সব সময়ই বাজেটের আকার এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার অতিমাত্রায় বাড়ানো হয়। পরে অর্থবছরের মাঝপথে এসে সেটা সংশোধন করা হয়। আবার অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাস্তবায়ন হার সংশোধিত বাজেটের চেয়েও কম। শুধু এখন না, আমি মনে করি এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের একটা বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরি করা দরকার। অকারণে বড় মাত্রায় বাজেট দেয়া মানে সেটা কাগুজে বাজেটে পরিণত হয়। অর্থনীতিতে ওই ধরনের বাজেট কোনো সুফল বয়ে আনে না। ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের পরেই অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রশ্ন: সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কতটা বাস্তবে কার্যকর হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? ধাক্কা মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কী করণীয়?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : প্রথম দফায় যেসব পদক্ষেপ ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও চলমান রাখা। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার জন্য যে বরাদ্দ রয়েছে সেগুলো বাড়িয়ে চলমান রাখা। ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে লকডাউন কত দীর্ঘ হয় তার ওপর। আর লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলা কঠিন। এ অবস্থায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষা ও বণ্টন ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে।
প্রশ্ন: ঘাটতি মোকাবেলায় বা সামাল দিতে করণীয় কী?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : আমি মনে করি করহার বাড়ানোর সুযোগ খুব একটা নাই। যারা কর দেয়ার কথা, তারা কিন্তু কর দিচ্ছে না। তাদের কর দেয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। যাদের কর দেয়ার সক্ষমতা আছে, তাদের নিকট থেকে কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এক বছরে বড় মাত্রায় খুব একটা অগ্রগতি হবে সেটা আশা করা যায় না।
প্রশ্ন : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো ও নিরাপদে থাকবেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : তোমাকেও ধন্যবাদ। তোমরাও ভালো থাকবে, নিরাপদে থাকবে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন: হামিদ সরকার ( দৈনিক নয়াদিগন্ত অন লাইনের সৌজন্যে)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com