বরগুনাসহ দেশের সর্বত্রই বেড়েছে তরমুজের দাম। ক্রেতারা বলছেন, কৃষকের ক্ষেতের চেয়ে বাজারে কয়েকগুণ বেশি তরমুজের দাম। তবে বেড়ে যাওয়া এই দামের সুফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, বাজারে চাহিদার সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট চক্র ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ইচ্ছেমতো দামে তরমুজ বিক্রি করছেন। এতে একদিকে যেমন ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত কৃষক, অপরদিকে চড়া দামে তরমুজ কিনতে হয় ক্রেতাদের। রাজধানী শহর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে। অথচ মাঠে পাইকাররা কিনে নিচ্ছেন তরমুজের ক্ষেত।
৫ এপ্রিল দেশব্যাপী প্রথম লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এর আগেই কিছু পাইকার কৃষকদের কাছ থেকে কমমূল্যে তরমুজ কিনে রাখে। এরপর প্রচ- দাবদাহ, রমজানের কারণে বাজারে তরমুজের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। আর এ সুযোগে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট চক্র দাম বাড়িয়ে বাজারে তরমুজ বিক্রি করছে। রমজানের আগে ১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া তরমুজের এখন বাজারে দাম ৪০০-৫০০ টাকা। অর্থাৎ, রমজানের আগে থেকে এ পর্যন্ত বাজারে চারগুণেরও বেশি দামে তরমুজ বিক্রি হচ্ছে।
বরগুনার স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রচুর পরিমাণ তরমুজের সমারোহ। বাজারের বেশ কয়েকটি আড়তে তরমুজ বোঝাই। আড়তের সামনেই বরগুনার তরমুজের মূল বাজার। এখানের খুচরা বিক্রেতা মিলন চন্দ্র রায় বলেন, রোজার শুরুতেই চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, বেড়েছে দামও। লকডাউনের শুরুর তিনদিন তরমুজের চাহিদাও যেমন কম ছিল, দামও ছিল অর্ধেক। অর্থাৎ, এখন যে তরমুজটি ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়, সেটি ওই সময়ে ১০০ টাকায় বিক্রি হতো।
আনিসুর রহমান ও আবদুল মন্নানও একই বাজারের খুচরা বিক্রেতা। এরা আড়ত থেকে তরমুজ কিনে বাজারে বিক্রি করেন। তারা জানান, সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দামে তিনি তরমুজ বিক্রি করেছেন। মাঝারির সাইজের এক একটি তরমুজ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া মোটামুটি ছোট সাইজের ১০০ ও ৫/৬ কেজি ওজনের এক একটি তরমুজ ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় তরমুজ বিক্রি হয়।
যেভাবে ক্রেতার কাছে পৌঁছায় তরমুজ: চাষি থেকে ক্রেতা এর মাঝখানে তিন হাত ঘুরে বাজারের ক্রেতাদের কাছে তরমুজ পৌঁছায়। প্রথমে ক্ষেত থেকে পাইকাররা স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে তরমুজ ক্রয় করেন। এরপর পাইকাররা এসব তরমুজ জেলা ও জেলার বাইরের আড়তে সুবিধাজনক দামে বিক্রি করেন। আড়ত থেকে আবার খুচরা বিক্রেতা কিনে নিয়ে হাটে বাজারে তরমুজ বিক্রি করেন। এদের প্রত্যেকেই লাভে তরমুজ বিক্রি করে থাকেন। আবদুল হক নামের একজন পাইকার বলেন, এ বছর বরগুনার বালিয়াতলী থেকে ১২ লাখ টাকার তরমুজ ক্রয় করেছেন। এসব তরমুজের একাংশ যশোরের রূপসী বাজারের আড়তে বিক্রি করেছেন, বাকিগুলো বরগুনা বাজারে। তিনি বলেন, ক্ষেত থেকে ক্রেতা এর মাঝখানে প্রতিটি তরমুজের দামের ব্যবধান হয় গড়পরতা ৫০-১০০ টাকার মতো।
বরগুনা সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের বেশ কিছু তরমুজ চাষির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ওই কৃষকরা জানান, তরমুজ বিক্রির মৌসুমে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি সিন্ডিকেট করেন। এদের বাইরে গিয়ে কোনও কৃষক যেমন তরমুজ বিক্রি করতে পারেন না, তেমনি কোনো পাইকার কিনতেও পারবেন না। সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই পাইকার ও চাষিদের তরমুজ বিকিকিনি করতে হয়। এই চক্রটি কৃষকের ক্ষেত পর্যবেক্ষণে রাখে। এদের বাইরে কোনও চাষি যেমন ক্ষেত বিক্রি করতে পারেন না, তেমনি কোনও পাইকারও ক্ষেত ক্রয় করতে পারবেন না।
পাইকাররা তরমুজ কিনতে আসার পর এরা পাইকারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজেরা প্রভাব খাটিয়ে বাজারের চেয়ে কম দামে তরমুজ কিনে নেন। এরপর পাইকারদের কাছে লাভে ওই তরমুজ বিক্রিও করে দেন। অর্থাৎ, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কোনও পাইকার তরমুজ কিনতে পারেন না, আবার কৃষক সরাসরি পাইকারের কাছে তরমুজ বিক্রি করতে চাইলে এরা মাঝখানে বাঁধ সাধেন। ভয়-ভীতি দেখান। হুমকি দেন। কোনও পাইকার বা কৃষক সরাসরি তরমুজ ক্রয়-বিক্রয় করলেও রেহাই নেই, এদের টাকা দিতেই হয়। তরমুজ চাষী মোহাম্মদ রিপন মিয়া, ইব্রাহীম মিয়া, আবদুর রশিদ, কামাল মুন্সি, বাবুল মুন্সিসহ বেশ কয়েকজন চাষি জানান, তারা সপ্তাহখানেক আগে পাইকারদের কাছে তরমুজ বিক্রি করে দিয়েছেন। তখন তাদেরকে বোঝানো হয়েছে, লকডাউনে পরিবহন পাওয়া যাবে না, ক্রেতা নেই, এসব কারণে দাম কম। কিন্তু, এক সপ্তাহের ব্যবধানে এখন যে দাম, তার অর্ধেকেরও কম দামে তরমুজ বিক্রি করতে হয়েছে।
বরগুনা সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের চালিতাতলী এলাকায় দেলোয়ার গাজীর নেতৃত্বে সবুজ গাজী ও মনির খান, সিরাজ, মিরাজ, মাসুমসহ বেশ কিছু ব্যক্তি এই সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয় তরমুজ চাষিদের অভিযোগ। একই ইউনিয়নের পরীরখাল, বানাই, লতাকাটা, গর্জনবুনিয়া, আমতলী-নিমতলী এলাকার তরমুজ চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকার তরমুজ বিক্রি করতে হয় স্থানীয় আবদুল হালিম নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে। তিনি পাইকারদের নিয়ন্ত্রণ করেন এবং কৃষকদেরও তার মাধ্যমেই তরমুজ বিক্রি করতে হয়। কৃষকরা জানান, এ বছরও আবদুল হালিমের মাধ্যমে তারা পাইকারদের কাছে তরমুজ বিক্রি করেছেন। আবদুল হালিম মাঝখান থেকে বিনা পরিশ্রমে তাদের উৎপাদন করা ফসলে ভাগ বসাচ্ছে দেখার কেউ নেই।
মোজাম্মেল হোসেন নামের একজন তরমুজ চাষি জানান, এ বছর লকডাউনে পরিবহন সংকটের কারণে বাজারে তরমুজের চাহিদা নেই এমন কথা বলে সিন্ডিকেট চক্র কম দামে তরমুজ কিনে নিয়েছেন। বাজারে এখন যে দামে তরমুজ বিক্রি হয়, কৃষক তার অর্ধেকের কম দামে তরমুজ বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, অধিকাংশ তরমুজ চাষি ইতোমধ্যে পাইকারদের কাছে তরমুজ বিক্রি করে ফেলেছেন। বাবুল মুন্সি বলেন, ‘আমরা ক্ষেত থেকে যে তরমুজটি ১০০ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন বাজারে সেই তরমুজের দাম ৪০০ টাকা। যদিও আমাদের লস হয়নি, কিন্তু, ওরা অনেক বেশি দরে বিক্রি করছে দেখে আমাদের মনে হচ্ছে আমরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের কাছ থেকে তারা ছোট-বড় সাইজ দেখে দাম ঠিক করেছে। এখন বাজারে নাকি বিক্রি করছে কেজি দরে। আমরাও চাই মানুষ পিস হিসেবে তরমুজ কিনে খাক। এত দামে যেহেতু বেচি নাই, তাই ক্রেতার ওপর এত চাপ পড়ুক তা চাই না।’
তিনি আরও বলেন, সিন্ডিকেট চক্র পাইকারদের সঙ্গে আঁতাত করে তাদের টাকা দিয়েই কৃষকদের কাছ থেকে তরমুজ কিনে নেয়। এরপর সেই তরমুজ তারা আবার পাইকারদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে। এদের কারণে পাইকাররা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে তরমুজ কিনতে পারেনা। বরগুনা সদরের তরমুজ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবদুল হালিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বালিয়াতলী তরমুজ চাষি কল্যাণ সমবায় সমিতি রয়েছে। কৃষকদের সুবিধার্থে সমিতির মাধ্যমে তরমুজ বিক্রি হয়। তবে বাধ্যবাধকতা নেই, কৃষক চাইলে সমিতির বাইরে গিয়েও তরমুজ বিক্রি করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আমি পাইকার ও ক্রেতাদের সহযোগিতা করি। এখানে কোনও সিন্ডিকেট নেই।
দেলোয়ার গাজী বলেন, আমরা কোনও সিন্ডিকেট করি না। দূরের পাইকাররা এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, আমি তাদের তরমুজ ক্রয়ে সহযোগিতা করি। এর বিনিময়ে তিনি খুশি হয়ে যদি কিছু টাকা দেন তাই নিয়ে থাকি। আমাদের এলাকার কৃষকদের ঠকিয়ে পাইকারদের জিতিয়ে লাভ করার মতো মানসিকতা আমাদের নেই।
আমতলী উপজেলার বাঁধঘাট চৌরাস্তা, একে স্কুল ও গাজীপুর বন্দরের তরমুজ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে বেশ ক্রেতা রয়েছেন। মাঝারি ধরনের একটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায়। বড় ধরনের তরমুজ ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা গত বছরের তুলনায় চারগুণ। কুকুয়া ইউনিয়নের চুনাখালী গ্রামের ওহাব মৃধা, বাহাউদ্দিন হাওলাদার ও রাজ্জাক মৃধা বলেন, ‘তিনজনে যৌথভাবে ৩৬ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। ক্ষেত থেকে ৩১ লাখ টাকা বিক্রি করেছি। কিন্তু, বাজারে এর দাম এখন ৭০ লাখ টাকারও বেশি।
আমতলীর গাজিরপুর, সোনাখালী, কুকুয়া, চুনাখালীসহ তরমুজ চাষ হয় এমন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুর বন্দরের সোহেল রানা নামের এক ব্যক্তি পাইকারদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এলাকার কিছু সহযোগীদের নিয়ে তিনি সিন্ডিকেট করেছেন। তাদের মাধ্যমেই ক্ষেত থেকে পাইকাররা তরমুজ কিনেন, চাষিদেরও বিক্রি করতে হয়। এ কারণে কৃষক ন্যায্যমূল্যে তরমুজ বিক্রি করতে পারছেন না। এ বছরও সোহেলের মাধ্যমেই অধিকাংশ কৃষকের তরমুজ বিক্রি করতে হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে সোহেল গাজী বলেন, সিন্ডিকেট কথাটি সত্য নয়, আমি সহযোগিতা করি যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্যে তরমুজ বিক্রি করতে পারেন। পাইকারদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখি, যাতে সময়মতো তারা তরমুজ ক্রয় করতে পারে। জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়ের বাজার অনুসন্ধানকারী টি. এম. মাহবুবুল হাসানের যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তরমুজের দাম বেশি। তরমুজ চাষীরা কৃষি বিভাগের সহায়তা নিয়ে বিক্রি করতে চাইলে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনও প্রকার বাধার সৃষ্টি যাতে না হয় সে ব্যাপারে আমরা কৃষি বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় সহায়তা করতে প্রস্তুত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) কৃষিবিদ আবদুল ওয়াদুদ বলেন, কৃষি বিভাগের সহায়তায় এ বছর বরগুনায় তরমুজের বাম্পার ফলন হয়েছে। ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত কৃষিপণ্য তরমুজ বিক্রিতে কৃষক সহায়তা চাইলে কৃষি বিভাগ তাদের সম্ভব সব সহায়তা দিতে প্রস্তত রয়েছে। বরগুনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বরগুনা কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি রবি মৌসুমে বরগুনা জেলায় চার হাজার ৪৩ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। জেলার বরগুনা সদর ও আমতলী উপজেলায় মূলত তরমুজের আবাদ হয়। এর মধ্যে বরগুনা সদরে দু’হাজার ২০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এবারও সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয়েছে বরগুনা সদর উপজেলার এম,বালিয়াতলী ইউনিয়নে। আমতলী কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর আমতলীতে তরমুজের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৯৯০ হেক্টর। ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। আমতলি উপজেলার চাওড়া ও হলদিয়া এই দুই ইউনিয়নে মোট এক হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে।