লন্ডনের মেয়র হিসেবে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন লেবার পার্টির নেতা সাদিক খান। কনজারভেটিভ পার্টির সাউন বেইলিকে হারিয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। প্রথম দফার ভোটে দুইজনের কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ হয়। সেখানে ৫৫ দশমিক ০২ শতাংশ পপুলার ভোট পেয়েছেন সাদিক খান।
সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য সাদিক খান যখন ২০১৬ সালে প্রথম লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন তখন তিনি ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনও দেশের রাজধানী শহরের প্রথম মুসলমান মেয়র। সিটি হলে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, ‘একটি উন্নত, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লন্ডন গড়ে তোলার জন্য সমস্ত শক্তি কাজে লাগাবেন।’ গ্রিন পার্টির সিয়ান বেরি তৃতীয় হয়েছেন আর লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির লুইসা পোরিট হয়েছেন চতুর্থ। পাঁচ শতাংশ ভোটের কম পাওয়ায় পোরিট জামানতও হারিয়েছেন।
নির্বাচনের পুরো সময়জুড়েই জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন সাদিক খান। নির্বাচনি জরিপে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, তিনি প্রথম দফায় অর্ধেকের বেশি ভোট পেতে পারেন। ৫১ বছর বয়সী সাদিক খান ২০১৬ সালে তার প্রথম দফায় পাওয়া ভোটের রেকর্ড ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার দুই লাখ ২৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে এ ব্যবধানের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ১৫ হাজার ৫২৯। এবার সাদিক খানের সবচেয়ে কাছের প্রতিদ্বন্দ্বী বেইলি পেয়েছেন প্রথম ও দ্বিতীয় দফা মিলিয়ে ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। ফলাফল ঘোষণার পর সাদিক খান বলেন, ‘আমি সবসময়ই সব লন্ডনবাসীর জন্য মেয়র হিসেবে কাজ করবো, যাতে এই শহরের প্রতিটি ব্যক্তির জীবনমানের উন্নতি হয়।’ তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্যজুড়ে নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশ, এমনকি আমাদের শহরগুলোও গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে আছে। ব্রেক্সিটের ক্ষত এখনও পুরোপুরি সারেনি। নিষ্ঠুর সাংস্কৃতিক লড়াই আমাদের আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।’
কে এই সাদিক খান: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ছেলে। তিনি তার মা-বাবার আট সন্তানের একজন। পাকিস্তান থেকে আসা সাদিক খানের বাবা ছিলেন বাস ড্রাইভার এবং মা জীবিকা নির্বাহের জন্য সেলাইয়ের কাজ করতেন। তারা থাকতেন দক্ষিণ লন্ডনের একটি এলাকায় দরিদ্রদের জন্য তৈরি সরকারি কাউন্সিল ফ্ল্যাটে। ছোটবেলা থেকেই সাদিক খান নিজে যে আদর্শে বিশ্বাসী তা নিয়ে লড়তে এবং সাফল্যের জন্য সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে পিছপা হননি। তার বাবা আমানুল্লাহ খান এবং মা সেহেরুন খান পাকিস্তান থেকে লন্ডনে যান ১৯৭০ সালে সাদিক খানের জন্মের কিছুদিন আগে। সাদিক খান তাদের আট ছেলে মেয়ের মধ্যে পঞ্চম। তারা সাত ভাই এবং এক বোন। দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের যে তিন-কামরার ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন, সেখানে তাদের বড় পরিবারকে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলে তিনি পড়তেন। সেখানেই ১৫ বছর বয়সে তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং লেবার পার্টিতে যোগ দেন। আর্নেস্ট বেভিন কলেজ নামে ওই স্কুলের প্রধান ছিলেন যুক্তরাজ্যের কোনও মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম মুসলমান প্রধান শিক্ষক। সাদিক খান ছোটবেলা থেকেই মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে লালন করেছেন। মা-বাবার কাছ থেকে এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন যে, ‘কোথাও অন্যায় কিছু দেখলে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা তোমার কর্তব্য।’
তিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। ফুটবল, বক্সিং ও ক্রিকেট অনুরাগী ছিলেন। এমনকী তরুণ হিসেবে তিনি সারে কাউন্টি ক্রিকেট দলেও কিছুদিন ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেছেন, ফুটবল মাঠে কীভাবে তাকে ও তার ভাইকে বর্ণবাদী মন্তব্য শুনতে হয়েছে, যার কারণে তিনি ঘরে বসে খেলা দেখাই ‘’নিরাপদ’ মনে করতেন। পরে তিনি লিভারপুল দলের ভক্ত হয়ে ওঠেন। প্রথমদিকে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন দন্ত চিকিৎসক হবেন। পরে একজন শিক্ষকের পরামর্শে তিনি আইন পড়তে যান। ওই শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, তুমি সবসময় তর্ক করো। ১৯৯৪ সালে তিনি একটি আইন সংস্থায় মানবাধিকার আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই তার সাদিয়া আহমেদের সঙ্গে তার পরিচয় ও বিবাহ। সাদিয়াও আইন পড়তেন এবং কাকতালীয়ভাবে তিনিও বাসচালকের কন্যা। সাদিক-সাদিয়া দম্পতির দুই কন্য সন্তান আছে – আনিসা ও আম্মারা। সাদিক খান স্থানীয় প্রশাসনে ১২ বছর কাজ করেছেন। ২০০৪ সালে আইনজীবীর কাজ ছেড়ে তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং এলাকা থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।
রাজনীতিতে বিভিন্ন দলে তার সমসাময়িকরা বলেছেন সাদিক খান খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ও একগুঁয়ে ব্যক্তি। তবে তার যুক্তি খারিজ করে দেওয়া কঠিন। ২০১০ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাদিক খান, বলেছিলেন, ‘আমি উদ্ধত কোনও মন্তব্য করতে চাই না। তবে ব্রিটিশ মুসলিম স¤প্রদায়ের মধ্যে গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। খুব কম মুসলমানকে বলতে শোনা যায়, আমি একইসঙ্গে ব্রিটিশ, মুসলমান ও লন্ডনবাসী; এ নিয়ে আমি গর্বিত।’ সূত্র: বিবিসি।