সার্ক মৃত, সাসেকে বিপুল অংকের বিনিয়োগ চলছে
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট সার্কের যাত্রা ১৯৮৫ সালে। এর ১৬ বছর পর সার্কভুক্ত চার দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে নিয়ে যাত্রা করে উপ-আঞ্চলিক জোট সাউথ এশিয়ান সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন (সাসেক)। পরবর্তী সময়ে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ এবং সর্বশেষ মিয়ানমার সাসেকে যুক্ত হয়। কালের পরিক্রমায় সার্ক এখন মৃতপ্রায়। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোটটির কার্যক্রম এখন নেই বললেই চলে। যদিও উপ-আঞ্চলিক জোট সাসেকের সক্রিয়তার মাত্রা এখন অনেক বেশি। এ সক্রিয়তার প্রধান জ্বালানি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বিনিয়োগ। বৃহত্তম বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে সাসেকভুক্ত দেশগুলোর সড়ক ও বন্দর যোগাযোগসহ সার্বিক কানেক্টিভিটিসহ অবকাঠামো ও বাণিজ্য উন্নয়ন খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে চলেছে এডিবি।
নিয়মিত বিরতিতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন। ওই বছর নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয় সার্কের অষ্টাদশ সম্মেলন। এর দুই বছর পর ২০১৬ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে জোটের ঊনবিংশতম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক জোটটির আর কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। জোটটি নিয়ে এ মুহূর্তে কোথাও তেমন কোনো আলোচনাও নেই। এ মুহূর্তে বরং উপ-আঞ্চলিক জোট সাসেকের সক্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি।
গঠনের পর প্রথম ১৫ বছর সাসেকের কার্যক্রম খুব একটা গতিশীল ছিল না। ২০১৬ সালে সদস্য দেশগুলো গ্রহণ করে সাসেক অপারেশনাল প্ল্যান ২০১৬-২৫। ১০ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জোরালো হয়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক জোটটির কার্যক্রম। এক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক বিনিয়োগে জোর দেয়া হয় পরিবহন, বাণিজ্য জোরদারকরণ, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়নের দিকে। এর পরের বছরই সাসেকভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীরা নয়াদিল্লিতে গ্রহণ করেন এক নতুন রূপকল্প ‘সাসেক: পাওয়ারিং এশিয়া ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’। প্রাকৃতিক সম্পদ, শিল্প সম্ভাবনা ও কানেক্টিভিটি—এ তিন বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে গ্রহণ করা হয় রূপকল্পটি। এর পর থেকেই সাসেকের অর্থনৈতিক কার্যক্রম জোরালো হয়ে ওঠে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক জোটগুলোর মধ্যে সাসেকের সক্রিয়তা বাড়ছে। এ ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে উপ-আঞ্চলিক জোটটির বৃহত্তম বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে এডিবি এ অঞ্চলের অর্থনীতি, বাণিজ্য এমনকি ভূরাজনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। এক্ষেত্রে ভারত ও জাপানের সঙ্গে চীনের বৈরিতা বড় নিয়ামক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, সাসেকের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এডিবিও বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে। এ জোটে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ভারত। উপ-আঞ্চলিক জোটটি গড়েও উঠেছে মূলত ভারত ও ভারতকে ঘিরে থাকা দেশগুলোকে নিয়ে। অন্যদিকে এডিবির নেতৃত্ব দিচ্ছে এশিয়ার অর্থনৈতিক পাওয়ারহাউজ জাপান। এখন পর্যন্ত সংস্থাটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাপানিরাই।
ভারত ও জাপান—দুটি দেশই বর্তমানে এশিয়া-প্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠা ঠেকাতে দুটি দেশই বদ্ধপরিকর। সেক্ষেত্রে সাসেকে বিনিয়োগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখার পাশাপাশি চীনের বিআরআই-নির্ভর ক্রমবর্ধমান প্রভাবকেও মোকাবেলা করতে পারে এডিবি।
তবে এর মধ্যেও সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে সাসেকের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, যেকোনো বিদেশী বিনিয়োগ কিংবা সহযোগিতার পেছনে ভূরাজনীতি থাকবেই। এটাই বাস্তবতা। ভূরাজনীতির চাপ সামাল দিয়েই আমাদের উন্নয়ন কর্মকা-গুলো গতিশীল করতে হবে। এডিবি আমাদের বড় উন্নয়ন সহযোগী। আবার চীন, ভারত কিংবা ইউরোপের দেশগুলোও কিন্তু আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। উন্নয়ন কর্মকা- এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নীতি হওয়া উচিত কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। এ নীতির পাশাপাশি আমাদের উন্নয়ন কর্মকা-ে সঠিক প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতার বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। উন্নয়নগুলো যেন টেকসই হয়, সে বিষয়েও সচেষ্ট থাকতে হবে।
সাসেকভুক্ত দেশগুলোয় এডিবি এখন ক্রমেই বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে সাসেকের পোর্টফোলিওতে মোট প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ৪১। উপ-আঞ্চলিক জোটটির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশে গৃহীত এসব প্রকল্পে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৮২৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে এডিবির অর্থায়ন ছিল ৪৮৫ কোটি ডলার। সাসেক অপারেশনাল প্ল্যান ২০১৬-২৫ গ্রহণের তিন বছরের মাথায় সাসেকের প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫। এসব প্রকল্পের মোট নির্ধারিত ব্যয় ১ হাজার ২৫৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে এডিবির অর্থায়ন অনুমোদন ৭২৩ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত বছরের মধ্যে সাসেক অপারেশনাল প্ল্যানের অধীনে প্রস্তাবিত মোট প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১২তে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের প্রয়োজন ৫ হাজার ৮৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে ৭৮টিতে মোট ৪ হাজার ৫৮৪ কোটি ডলার অর্থায়ন করা যাবে বলে মনে করছে এডিবি। অন্যদিকে গত বছরের জুন পর্যন্ত পাওয়া সাসেকের আওতায় জোটভুক্ত দেশগুলোয় বিভিন্ন প্রকল্পে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এসব প্রকল্পে শীর্ষ অর্থায়নকারী এডিবি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাসেকে এডিবির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক জোট হলেও সাসেক সচিবালয় অবস্থিত ফিলিপাইনের ম্যানিলায়। সেখানে এডিবির সদর দপ্তরকেই জোটের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জোটের ইতিহাসের সঙ্গেও এডিবি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। উপ-আঞ্চলিক জোট হিসেবে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল নিয়ে গঠন করা হয় ‘সাউথ এশিয়ান গ্রোথ কোয়াড্রাঙ্গল’। পরের বছরই সার্কের অনুমোদন পায় উপ-আঞ্চলিক জোটটি। প্রতিষ্ঠাতা চার দেশের পক্ষ থেকে সে সময় উপ-আঞ্চলিক উন্নয়নে সহযোগিতার জন্য এডিবির সহযোগিতা চাওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে গঠন করা হয় সাসেক প্রোগ্রাম। ২০১৪ সালের মে মাসে এতে যোগ দেয় মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা। ২০১৭ সালে জোটের সপ্তম সদস্য দেশ হিসেবে যুক্ত হয় মিয়ানমার।
এডিবির তথ্যমতে, সাসেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবহন, যোগাযোগ ও কানেক্টিভিটি গুরুত্ব পায় সবচেয়ে বেশি। সাসেক অপারেশনাল প্ল্যান ২০১৬-২৫-এর আওতায় বাংলাদেশে চলমান বেশকিছু প্রকল্পে নানা মাত্রায় বিনিয়োগ করছে সংস্থাটি।
সাসেক অপারেশনাল প্ল্যান ২০১৬-২৫-এর হালনাগাদ প্রতিবেদনে জোটের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগকৃত প্রকল্পের তালিকা তুলে ধরেছে এডিবি। সেসব প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এর মধ্যে অনেকগুলো প্রায় শেষের পথে। বাকিগুলোও চলমান রয়েছে পূর্ণগতিতে।
ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সরকারের সেতু বিভাগ। আগামী বছর এক্সপ্রেসওয়েটির কিছু অংশ (বিমানবন্দর-বনানী) চালুর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। অন্যদিকে অর্থায়ন জটিলতায় এখনো শুরু হতে পারেনি ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।
ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে সাভারের বলিয়ারপুর থেকে নিমতলী-কেরানীগঞ্জ-ফতুল্লা-বন্দর হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ পর্যন্ত ৩৯ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ।
এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। মহাসড়কটিতে দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়কের কাজ চলমান। শেষের দিকে চলে এসেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গাজীপুর-বিমানবন্দরের মধ্যে গড়ে তোলা হচ্ছে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন।
পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী বছরের জুনে সেতুটি চালুর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। পদ্মা সেতুর জন্য ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েসহ নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনসহ ঢাকা-টাঙ্গাইল ও টাঙ্গাইল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলমান। চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কও।
একইভাবে বেনাপোল-যশোর, রংপুর-বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী-রংপুর, হাটিকুমরুল-বনপাড়া-ঝিনাইদহ, খুলনা-মোংলা, ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা, সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের মতো দেশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক উন্নয়নের কাজ চলমান বা পরিকল্পনাধীন রয়েছে সাসেকের মাধ্যমে।
সড়কের পাশাপাশি রেলওয়েরও অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে সাসেকের মাধ্যমে। ঢাকা-চট্টগ্রামে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। একই করিডোরে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণও পরিকল্পনাধীন। প্রায় শেষ পথে চলে এসেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ নির্মাণকাজ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঈশ্বরদী থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ডাবল লাইন, সিরাজগঞ্জ-বগুড়ার মধ্যে নতুন রেলপথ নির্মাণ, আব্দুলপুর-পাবর্তীপুরের মধ্যে দ্বিতীয় রেললাইন নির্মাণসহ আরো একাধিক প্রকল্প পরিকল্পনাধীন ও বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো দেশ কিংবা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় বাণিজ্যকে। সাসেক কিংবা বিআরআইয়ের ক্ষেত্রেও এ বাণিজ্যটা সবার আগে চলে আসে। ভূরাজনৈতিক বিষয় থাকলেও আমি মনে করি সেটা গৌণ। আর ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতির কারণে ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলোয় বাংলাদেশ নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।