সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ন

এক দশকের ব্যবধানে বেতন-ভাতায় সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি ২২১%

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৫ জুন, ২০২১

২০২৩-২৪ অর্থবছর নাগাদ প্রক্ষেপণ

মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে দেশে দেশে নেয়া হয়েছে কৃচ্ছ্র সাধনের নানা উদ্যোগ। গুরুত্ব পাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়গুলো। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় গত বছরই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয় কাতার ও ভিয়েতনাম। পরবর্তী সময়ে অন্য অনেক দেশই সরকারি ব্যয়ের খাত সংকুচিত করার পথে হেঁটেছে। যদিও চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই দেশে গত অর্থবছরের মতো এবারো সরকারি কর্মীর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মহামারীর অনেক আগে থেকেই এ ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেতন-ভাতায় সরকারের ব্যয় ছিল ২৮ হাজার ৮২০ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছর নাগাদ ৯২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেক্ষেত্রে এক দশকে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির হার দাঁড়াচ্ছে ২২১ শতাংশের বেশিতে। বৃহস্পতিবার সংসদে অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপিত তথ্যে দেখা যায়, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ ব্যয় মোট পরিচালন বাজেটের ১৯ শতাংশ। আর পরিচালন বাজেটের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে পেনশন পরিশোধে। সে হিসেবে বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধেই পরিচালন বাজেটের ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হবে।
‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪’ শীর্ষক বাজেট প্রকাশনার তথ্যমতে, বেতন-ভাতা খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় ছিল ৪০ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত হিসাবে এ খাতে সরকারের ব্যয় ৬৫ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে সরকারের ব্যয় ৮১ হাজার ৪৩০ কোটি ও পরের অর্থবছরে তা ৯২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ বেড়েই চলছে। সরকার নানাভাবে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর হয়ে যাওয়ার কারণে এমনটি ঘটছে। এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতি দুদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে আমলাদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে গিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বড় অংকের বেতন-ভাতা নিয়েও বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলারা চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। চলতি অর্থবছরেও বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলারা অদক্ষতা, সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার অনেক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। এত টাকা বেতন-ভাতা নেয়ার পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতিও থেমে নেই। আমলারা দিন দিন আরো শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে উঠছেন, যা সুশাসনের অন্তরায়।
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বৃহস্পতিবার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে জিডিপির বিপরীতে ঘাটতির প্রাক্কলিত হার দাঁড়াচ্ছে ৬ দশমিক ২ শতাংশে। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এ ঘাটতি পূরণের জন্য আগামী অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই নির্ভর করতে চাইছে বেশি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার কর আয় বাড়ানোর লক্ষ্য ধরা হয়েছে প্রস্তাবে।
সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পারফরম্যান্সের সঙ্গে যুক্ত নয়। এটি অনেকটা উপহার হিসেবে দেয়া হয়। এর সঙ্গে সেবা দেয়ার বিষয়টি যুক্ত না হওয়ায় তাদের মধ্যে সেবা প্রদানের মানসিকতা গড়ে উঠছে না। আগে সরকারি চাকরিকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করা হতো। পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য প্রতিযোগিতা চলত। এখন প্রতিযোগিতা করতে হয় না, এমনিতেই বছর শেষে বেতন-ভাতা নির্ধারিত নিয়মে বেড়ে যাচ্ছে। এটি সঠিক প্রক্রিয়া নয়। নির্দিষ্ট মানদ-ের ওপর ভিত্তি করে তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোটাই আন্তর্জাতিক রীতি। তারা এখন এসিআর নিয়ে মাথা ঘামান না। কারণ এটি আর এখন কোনো কাজেই ব্যবহার হয় না।
তিনি আরো বলেন, সিঙ্গাপুরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কত বাড়বে, সেটি নির্ধারণ করে দেশটির ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি কমিশন। বাংলাদেশেও এমন কমিশন করে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ ও বাড়ানো উচিত। আর করোনার মধ্যে সবাই যখন টিকে থাকার যুদ্ধে ব্যস্ত, সারা বিশ্বের সরকারগুলো নিজস্ব পরিচালন ব্যয় কমাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে রক্ষণশীল পথে হাঁটা উচিত ছিল। যেখানে মানুষ খেতে পারছে না, বিপুলসংখ্যক কাজ হারিয়েছে, নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ, সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত হয়নি। একটি দুর্যোগ হলে সবাই স্বেচ্ছায় একদিনের বেতন দান করেন। আর করোনা তো মহামারী, যেটি প্রায় দেড় বছর ধরে চলছে, সেখানে তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি। তাদের বেতন-ভাতা না বাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষে কমানো যেত। এ অর্থ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা হিসেবে দেয়া যেত, এমনকি নিচের দিকের কর্মচারীদের জন্যও ব্যয় করা যেত। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের বেতনের একটি অংশ করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেয়া উচিত ছিল। সংকটকালীন এ মুহূর্তে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো অনৈতিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শূন্য পদের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। পর্যায়ক্রমে শূন্য পদ পূরণে নিয়মিত বিসিএসের মাধ্যমে জনবল নিয়োগও হচ্ছে। তবে কয়েক দফায় বড় ধরনের পদোন্নতিতে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে স্ফীত হয়েছে জনবল। এতে সাংগঠনিক কাঠামোয় না থাকলেও পদায়ন করতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের। সর্বশেষ বেতন কাঠামোয় এমনিতেই সরকারি কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আর উচ্চপদগুলোয় বেশি জনবল থাকায় এ খাতে ব্যয় বেড়ে চলেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদিত পদসংখ্যা ১৭ লাখ ১০ হাজার ৭০৪। অনুমোদিত এসব পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৩ লাখ ৮২ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৮১৯ জন আর দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা রয়েছেন ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৬৫ জন। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী রয়েছেন যথাক্রমে ৮ লাখ ৪০ হাজার ও ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭২ জন।
গত এক দশকে রাজস্ব খাতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছয় লাখের বেশি পদ সৃজন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এসব নতুন পদ সৃজন করা হয়। এছাড়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো অর্ধলাখের মতো পদ সৃষ্টির কার্যক্রম। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ধারা জনসেবার মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমাদের এখানে সেবার প্রত্যাশিত মান অনুপস্থিত। এটির গুণগত মান কীভাবে বাড়ানো হবে তা দেখতে হবে। আর বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় যৌক্তিকীকরণের সুযোগ রয়েছে। প্রচলিত ব্যয়-উত্তর মূল্যায়ন ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যয়-পূর্ব মূল্যায়ন থাকা উচিত। এতে সংযম ও নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হবে।-বণিকবার্তা অনলাইন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com