যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রফতানি
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের এক ক্রেতা। মার্কিন বাজারে ওষুধ পণ্য পরিবেশক ও আমদানিকারক ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রফতানি ক্রয়াদেশ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। কয়েক দফা আলোচনা শেষে ক্রেতা জানায়, একই ওষুধ ভারত ও চীনের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম দামে দিতে পারছে। ফলে শেষ পর্যন্ত ক্রয়াদেশটি আর বাংলাদেশ পায়নি। এটি চলে যায় ভারতের এক উৎপাদনকারীর কাছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের বাজারের আকার প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার বা ৪২ লাখ কোটি টাকার। সম্প্রতি এ বাজার থেকে রফতানি ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করেছেন দেশের বড় ওষুধ পণ্য বিক্রেতারা। দেশটি ওষুধ পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্যে পরিণত হতে পারে। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে এ বাজার ধরতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশের বড় তিনটি ওষুধ উৎপাদক ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান স্কয়ার, বেক্সিমকো ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় পণ্যের মোড়ক বা প্যাকেজিং সামগ্রী নিয়ে, যা শতভাগ আমদানিনির্ভর।
মার্কিন বাজারে ওষুধ রফতানি করতে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক কনটেইনার, যা তৈরির সক্ষমতা নেই দেশের প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। আবার উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ওষুধ পণ্যের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় ক্রেতার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকেই প্লাস্টিক কনটেইনার কিনে তা ব্যবহার করতে হয়। আবার দেশীয় শিল্প সুরক্ষার স্বার্থে ওষুধের প্যাাকেজিংয়ের জন্য ব্যবহূত এ প্লাস্টিক সামগ্রীর ওপর আরোপ আছে উচ্চ হারের শুল্ক ও কর। ফলে ওষুধ তৈরি করতে পারলেও পণ্য সরবরাহের উপকরণের আমদানি ব্যয় যোগ হয়ে ওষুধের চূড়ান্ত দাম অনেক বেড়ে যায়।
ওষুধ শিল্প মালিকদের সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি ওষুধের স্থানীয় বাজারের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকা। দেশীয় ওষুধ শিল্প স্থানীয় চাহিদার শতকরা ৯৮ ভাগ পূরণের সক্ষমতা রাখে। পাশাপাশি এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশসহ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও ওষুধ রফতানি করা হয়। বর্তমানে দেশে ওষুধ উৎপাদনকারী ৩০টি কোম্পানি বিশ্বের ১৫১টি দেশে ওষুধ ও কাঁচামাল রফতানি করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ৯০ হাজার ডলারের ওষুধ রফতানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে রফতানি হয়েছে ১৪ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের। এ বাজার দ্রুত সম্প্রসারণ করতে উন্নত বিশ্বের বিশাল আকারের বাজারে প্রবেশের বিকল্প নেই। কিন্তু অস্বাভাবিক উৎপাদন খরচের চাপে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রফতানি বাজার সম্প্রসারণ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, সমস্যাটি নিয়ে গত বছর থেকেই সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে; কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। আলোচনা অব্যাহত আছে, আশা করছি দ্রুতই সমাধান হবে।
বর্তমানে মার্কিন বাজারে রফতানি করছে এবং প্লাস্টিক কনটেইনার আমদানি-সংক্রান্ত উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিজনিত সমস্যার মুখোমুখি হওয়া কোম্পানির মধ্যে আছে স্কয়ার, বেক্সিমকো ও ইনসেপ্টা। এ প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ পেয়েছে। কিন্তু শুল্ক ও কর দিয়ে রফতানি মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলোর প্রবৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনার আহ্বানে সাড়া দিলেও স্কয়ার, বেক্সিমকো ও ইনসেপ্টা সংশ্লিষ্টরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, মার্কিন বাজারে ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো প্লাস্টিক কনটেইনারের ওপর আরোপিত শুল্ক ও করের প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু অ্যাজিথ্রোমাইসিন ওষুধের বাজার রয়েছে ৭০ কোটি ডলারের। বিপুল পরিমাণ চাহিদার পরও বাংলাদেশে এজিথ্রোমাইসিনের এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট) আমদানিতে শুল্ক আরোপ থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারটি ধরা যাচ্ছে না। একদিকে এপিআইয়ের ওপর শুল্ক তার ওপর যে কনটেইনারে অ্যাজিথ্রোমাইসিন সরবরাহ হবে, সেই প্লাস্টিক কনটেইনারেও আরোপ আছে শুল্ক ও কর। সব মিলিয়ে মার্কিন বাজারটি ওষুধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রফতানি গন্তব্যে পরিণত হতে পারত, কিন্তু নানা জটিলতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চহারে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি শুল্ক ও ভ্যাটের কারণে উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে মার্কিন বাজারে ওষুধ রফতানিতে একাধিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। নিয়মিত রফতানিকারক হিসেবে স্কয়ার, বেক্সিমকো ও ইনসেপ্টাকে বেশি সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। এসব সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হিসেবে দেখা হচ্ছে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। কারণ প্রতিযোগী দেশের কোম্পানিগুলো যদি বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে ওষুধ দিতে পারে, তাহলে বাজারটি স্বাভাবিকভাবেই তাদের দখলেই চলে যাবে।
সমস্যা সমাধানে গত বছর থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা করে আসছিল ওষুধ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। সমস্যার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে এনবিআরকে কয়েকবার চিঠিও দেয়া হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসানের সই করা এ-সংক্রান্ত এক চিঠিতে মার্কিন বাজারসহ উন্নত বিশ্বে রফতানির সমস্যাগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠিতে যে সমস্যাগুলোর কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমেই আছে রফতানি পণ্যে মূল্য সংযোজনের শর্ত পূরণ না করা সংক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রযোজ্য উচ্চহারে শুল্ক ও কর পরিশোধ করে আমদানি করা প্লাস্টিক প্যাকেজিং সামগ্রী দিয়ে পণ্য প্রস্তুতের পর তার উৎপাদন মূল্য অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাওয়া উৎপাদন মূল্যের কারণে রফতানি মূল্যের তুলনায় মূল্য সংযোজন অনেক কমে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই রফতানি মূল্যের ওপর ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা প্রাপ্তির ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত পূরণ করা যাচ্ছে না।
এনবিআরকে পাঠানো ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, রফতানি মূল্যের ওপর নগদ আর্থিক সহায়তা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মূল্য প্রস্তাব করে অনেক বেশিসংখ্যক বিদেশী ক্রেতা আকর্ষণ করা যেত। কিন্তু নগদ সহায়তা প্রাপ্তির শর্ত পূরণ না করতে পারায় ক্রেতা আকর্ষণে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশে তৈরি হওয়া ওষুধের দাম সব মিলিয়ে প্রতিযোগী ভারত, চীনের চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে।
রফতানিকারকরা বলছেন, শুধু ভারত ও চীন নয় ক্ষেত্রবিশেষে ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি হওয়া ওষুধের চেয়েও বাংলাদেশের পণ্যের মূল্য বেশি হয়ে যাচ্ছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশক ও আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে ওষুধের আউটসোর্সিং করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
মূল্য সংযোজনের শর্তপূরণ না হওয়ায় নগদ সহায়তা প্রাপ্তি, প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়াসহ ওষুধ রফতানিতে সমস্যার মধ্যে আছে রফতানিকারকদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সমস্যা। তাদের দাবি, রফতানি বাজারের লক্ষ্যে তৈরি করা ওষুধের জন্য আমদানি করা প্লাস্টিক প্যাকেজিং সামগ্রীর ওপর উচ্চহারে শুল্কায়নের প্রভাবে প্যাকেজিং ইনভেন্টরি বাবদ দ্বিগুণ হারে ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের প্রয়োজন পড়ছে। এ প্রয়োজনের জোগান দিতে কোম্পানিগুলোর ফাইন্যান্স কস্ট বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচও অনেক বাড়ছে। রফতানিতে সমস্যাগুলোর মধ্যে সর্বশেষটি ভ্যাট-সংক্রান্ত। এক্ষেত্রে ওষুধ রফতানিকারকদের প্রতিনিধিরা বলছেন, কার্যকর নতুন ভ্যাট আইনের আলোকে রফতানি পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল ও প্যাকেজিং সামগ্রীর ডিউটি ড্রব্যাকের প্রচলিত সুবিধা প্রাপ্তির জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে দুঃখজনকভাবে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত রফতানি পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহূত কাঁচামাল ও প্যাকেজিং সামগ্রীর ডিউটি ড্রব্যাক সুবিধা থেকে কোম্পানিগুলো বঞ্চিত হচ্ছে। সূত্র: বণিকবার্তা