মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো এক সময় ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সৎ ব্যবসায়ী, মেধাবী উদ্ভাবক সবখানেই মুসলিমরাই থাকতেন সবার আগে। তারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল গবেষণা আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে। উত্তম নীতি, অবকাঠামো এবং গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে হয়েছিল বিশ্বের শক্তিশালী জাতি। কিন্তু কালের বিবর্তনে মুসলিম উম্মাহর পতন ঘটে। তারা নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। হয়ে গেছে সহায়হীন জাতি। যারা কেবল অন্ধ অনুকরণই করছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের আবার মূলে ফিরে যেতে হবে, অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহর দিকে। আমাদের প্রথম প্রজন্ম যেভাবে সফল হয়েছিল সে পন্থা অনুসরণই একমাত্র সমাধান। তার জন্য খুব সচেতনভাবেই আমাদের সেল্ফ-ডেভেলপমেন্টের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
নিজেদের পরিবর্তন না করলে আমাদের অবস্থার কখনোই উত্তরণ হবে না। ইসলাম থেকে যোজন-যোজন দূরে সরে গিয়ে সঙ্কটের মোকাবেলা কখনোই সম্ভব নয়। আজ আমরা তাই করছি। এর পরিণতিতে মুসলিমরা বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত হচ্ছে। আমাদের অপদস্ত করার কোনো প্রচেষ্টাই আর বাকি নেই। এ সবই আমাদের হাতের কামাই : ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ আরোপিত হয়, তা তোমাদেরই কর্মফল’ (৪২:৩০)।
দুনিয়ার মোহ আমাদের অন্ধ করে দিয়েছে, যার জন্য দ্বীন বিসর্জন দিচ্ছি অবলীলায়। এর ফলে আদতে আমরা নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছি। ‘আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তিনি (আল্লাহ) তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে নিয়ে আসবেন। তখন তারা তোমাদের মতো হবে না’ (৪৭:৩৮)।
এই আয়াত আমাদের জন্য হুঁশিয়ারি। যুগে যুগে এমন বহু শক্তিশালী জাতি এসেছিল। কিন্তু তাদের নাফরমানির জন্য আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাই আমরা নিশ্চয়ই চাইব না এমন পরিণতি। নিজেদের বাঁচাতেই আমাদের কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা উচিত। আমাদের আদর্শ হচ্ছে, ‘… তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (৩৩:২১)।
রাসূলুল্লাহ সা: হচ্ছেন আমাদের মডেল। বাস্তব নমুনা। তাঁর সাহাবিরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুন্নাহ অনুসরণ করতেন। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলেন সুন্নাহ হলো জীবন্ত কুরআন, কুরআনের অনুশীলন। সাহাবিরা ছিলেন ইসলামী মূল্যবোধের প্রতীক। গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসা মানুষের সাথে তাদের কর্মপন্থা মেলে না। কিন্তু আজ আমরা কোথায় আছি। যে ইসলামের জন্য মুসলিমরা সারা বিশ্বে সম্মানিত হয়েছিল, সে ইসলামকে বুঝে না বুঝে বিসর্জন দিচ্ছি।
আমাদের এই হীন অবস্থা থেকে বের হতে হলে জীবনযাপনের সব কিছুই হতে হবে ইসলামের বিধান অনুসারে। আমাদের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, কথা-কাজ সব কিছুই হবে কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক ও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আমাদের নিয়ত পরিশুদ্ধ করতে হবে। তা যেন পার্থিব সমৃদ্ধি, সুনাম ও জনপ্রিয়তা লাভের জন্য না হয়। এ পথ অবশ্যই মসৃণ নয়। কিন্তু এই কঠিনকে জয় করার মধ্যে একটা পরিতৃপ্তি আছে, অনন্যতা আছে। যা খুব কম মানুষই অনুভব করতে পারে। দীর্ঘদিন চাকরির খোঁজে থাকা কেউ যখন হাই স্যালারির কোনো সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে তার প্রয়োজন তীব্র হওয়া সত্ত্বেও। কিসে তাদের এত দৃঢ়তা দেয় অটল অবিচল থাকার? এটাই আল্লাহর জন্য নিজেকে সঁপে দেয়ার অনন্যতা। আল্লাহর জন্য ত্যাগ করলে তার সুফল আল্লাহ তায়ালা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। বান্দা ধৈর্য ও সবরের সাথে অপেক্ষার পর যখন নিয়ামত লাভ করে তখন দুনিয়াবি পরীক্ষাগুলো গৌণ মনে হয়। প্রকৃত সফল তো সেই যে নিজেকে সঁপে দিয়েছে আল্লাহর কাছে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে : ‘হে মানুষ তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সত্য এসেছে। সুতরাং যে হেদায়াত গ্রহণ করবে, সে নিজের জন্যই হেদায়াত গ্রহণ করবে। আর যে পথভ্রষ্ট হবে, সে নিজের ক্ষতির জন্যই পথভ্রষ্ট হবে। আর আমি তোমাদের অভিভাবক নই’ (১০:১০৮)।
আমাদের কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। বর্তমান মুসলিমরা তাদের দীর্ঘসূত্রতার জন্য পরিচিত। সময় নিষ্ঠার অভাবে মুসলিমদের ব্যাপারে মানুষের বিরূপ ধারণা গড়ে উঠেছে। একজন ব্যক্তি তার কাজের দ্বারাই মানুষের কাছে পরিচিতি ও স্বীকৃতি লাভ করে। এটিও উৎকর্ষ অর্জনের একটি কারণ। ইসলামের সৌন্দর্য তো এটাই। একজন প্রকৃত মুসলিম তো এমনই। যাদের জীবনযাপন সব কিছুতেই উৎকৃষ্টতা ও অনন্যতার ছাপ থাকবে। ইসলামই হবে আমাদের ‘ব্র্যান্ড’, আমাদের আত্মপরিচয়।
হয়তো এমন মনে হতে পারে যে, আমি একা চেঞ্জ হয়ে আর কী হবে বা আমি একা আর কী করতে পারব। কিন্তু শুধু একজন নারী-পুরুষের সম্মিলন থেকে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের আগমন ঘটেছে। হতে পারে অচেনা কোনো মানুষের সাথে কিছু সময়ের আলাপচারিতা, কাউকে দেয়া কোনো বই, কোনো সাদকা অথবা আমাদের কোনো কথা বা কাজের পরিণতি পরবর্তীতে অন্যদের জীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে পারে। যা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কেননা, ‘… পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মতো। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল দান করে’ (সূরাহ ইব্রাহিম :২৪, ২৫) আমাদের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কাজের পরিণতি ও বিশাল হয়ে যেতে পারে। কেননা ইতিহাস থেকেও আমরা এই শিক্ষাই পাই। শুধু একজন মানুষের পক্ষেও পৃথিবীকে বদলে দেয়া সম্ভব। শুধু আমাদের হতে হবে আল্লাহর অনুগত এবং সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসারী একজন ব্যক্তি।
বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতি দেখেও মুসলিম নামধারী আমরা নিশ্চুপ আছি ও অপেক্ষা করছি মিরাকলের। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ঈমান ও আমলের একনিষ্ঠতা ও প্রচেষ্টা ছাড়া সাফল্য আসবে না। রাসূলুল্লাহ সা: দীর্ঘ ২৩ বছর ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। তার পূর্ববর্তী নবীরাও একইভাবে ত্যাগ করেছেন। কোনো মিরাকল ঘটেনি। কিন্তু ধৈর্য ও সবরের সাথে আল্লাহর আনুগত্য করায়, তিনি তাঁদের ধারণাতীত সাফল্য দিয়েছেন। নগণ্য কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুসলিম বাহিনী বিপুলসংখ্যক কাফেরদের পরাজিত করেছে এর নজির অনেক আছে ইসলামের সোনালি অতীতে। তাদের এই জয়ের পেছনে একমাত্র সম্বলই ছিল আল্লাহর সাহায্য। এটাই মিরাকল। আবার অনেক যুদ্ধে তারা হেরেছিল তখনই, যখন তারা আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল। এর মূল রহস্য-আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পরিশুদ্ধ নিয়ত।
ইসলাম শুধু কিছু নিয়মনীতি বা আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়, এটি সম্পূর্ণ জীবনবিধান। তাই আমাদের জীবনে এর একনিষ্ঠ প্রয়োগ করতে হবে। কেননা বুদ্ধিমান মাত্রই নিজেকে সেই দিনের জন্য প্রস্তুত করে, যেদিন তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি মুসলিমেরই উচিত ইসলাম জীবনবিধানের আদলে নিজেকে বদলানোর শপথ করা। অন্যকে প্রভাবিত করার অন্যতম সফল উপায় হলো এর সফল মডেল তাদের দেখানো। আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, কথা ও কাজের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমেই ইসলামের আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। ইসলামকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পারলেই মুসলিমদের সুদিন আসবেই ইনশা-আল্লাহ।