বেলাবকে বলা হয় লটকনের রাজ্য। আনাচে কানাচে সর্বত্র লটকন গাছ আর গাছে গাছে লটকনের ঝুলে থাকা দেখতে অপূর্ব লাগে। গাছে গাছে আঙ্গুর ফলের মতো থোকায় থোকায় ঝুলে আছে হাল্কা গোলাপি ও সবুজ রঙের লটকন।এক সময়ের ‘কদরহীন’ লটকন এখন বর্ষা মৌসুমের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। এ ফল এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে মৌসুম শুরু হতেই এর স্বাদ নিতে অপেক্ষায় থাকেন দেশবাসী। শুধু তাই নয়, দেশের গ-ি পেরিয়ে এ ফলের স্বাদ ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশে। নরসিংদীর বেলাব উপজেলার বিভিন্ন ফল ও সবজি যেমন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে তেমনি লটকনও সারা বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। অল্প খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় লটকন চাষে ঝুঁকে পড়ছে অনেক ব্যবসায়ীরা। সহজ চাষপদ্ধতি, অধিক ফলন, অনুকূল আবহাওয়া আর উপযুক্ত মাটি থাকায় লটকন এখন অন্যতম অর্থকরী ফল হিসেবে পরিচিত। অতিরিক্ত পুষ্টি গুন সমৃদ্ধ সকল বয়সী লোকদের নিকট প্রিয় টকমিষ্টি ফল হিসেবে লটকনের চাহিদা দেশে-বিদেশে সমাধৃত। উপাদেয় সুমিষ্ট এ ফল এ ঋতুতে সবার ঘরে অন্যতম খাদ্য উপকরণ। ফলে লটকন চাষ এখন এলাকার কৃষকদের প্রধান চাষ বিবেচিত হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। বেলাব উপজেলার স্থানীয় বাজার, বেলাব, বারৈচা, নারায়নপুর, পোড়াদিয়া বাজার গুলোতে ইতিমধ্যে আসতে শুরু করেছে এ বছরের লটকন। হরেক স্বাদের লটকনের মিলনক্ষেত্র এসব বাজারে বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা এসে ভীড় জমায় এগুলো ক্রয় করে স্থানীয় বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে। রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয় বেলাবরের লটকন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বেলাবরের লটকন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও রপ্তানী হয় বলে জানা যায়। ভালোমানের লটকন প্রতিমণ ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একটু নিম্নমানের লটকন ২০০০ থেকে ৩০০০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। লটকন চাষে স্বাবল¤॥^ী হয়েছে অনেকে। লটকনের ব্যাপক চাহিদার কারণে এখানে প্রতি বছর নতুন নতুন অনেক লটকন বাগান গড়ে উঠেছে। চাহিদা পূরণ করতে লটকনের অনেক নার্সারীও গড়ে উঠছে। বেশ কয়েকজন চাষী বেলাব ডেইলি বাংলাদেশকে জানান, এ বছর একটু কম ফলন আসলেও দাম বেশি পাওয়ার আশা করছি। লটকনের বড় বড় বাগানের মালিকগণ অনেকে তাদের বাগান বিক্রি করে দিয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায় চন্দনপুর, হাড়িসাংগান, আমলাব, উজিলাব, নারায়ণপুর, পাটুলী, দাপুনিয়া, ভাবলা, সুটুরিয়া, বাজনাব এসব এলাকার বাগানীরা তাদের বাগানের ফলগুলো বাগানেই বিক্রি করে দিয়েছেন। গড়ে বিঘাপ্রতি দেড় লক্ষ টাকায় বা বড় হলে ২ লক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চকমখোলা গ্রামের শিক্ষক বিমল সূত্রধর জানান, আমার পুরাতন ২/৩ টি গাছসহ মাত্র এক বিঘার লটকন আড়াই লক্ষ টাকা বিক্রি করেছি। পাটুলীর অপর এক কৃষক আলফাজ উদ্দীন জানান, তার পাঁচ বিঘার দুটি বাগান ৬ লক্ষ টাকা দাম উঠেছে। আরও বেশি হবে বলে আশা করছি। আমিনুল হক আফ্রাদ বলেন, এবছর আমার তিন বিঘা জমির লটকন ৫ লক্ষ টাকায় বিক্রি করার আশা রাখি। লটকনের স্বাদ অম্লমধুর, পুষ্টিমান প্রচুর। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি রয়েছে। এছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আমিষ, স্নেহ, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। আমাদের দেহের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন চারটি লটকনই সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। লটকনের ভেষজগুণও রয়েছে। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ ও বমিভাব দূর করতে কার্যকর। শুকনো পাতার গুড়ো ডায়রিয়া নিরাময় ও মানসিক চাপ কমায়। কামাল নামে এক ব্যাাবসায়ী জানান,আমি বেলাব বাজার থেকে লটকন কিনে ঢাকায় সাপ্লাই করি। ঢাকার অলিতে গলীতে বেলাব উপজেলার লটকন দেখা যায়। ভালো ব্যবসা হয় প্রতিবছর। ঢাকা থেকে এ ফল দেশের বাহিরেও রপ্তানী করা হয়। আমি লটকন চাষীকে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখি প্রতি বছর। আগের তুলনায় লটকনের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। ব্যবসায়ী জালাল মিয়া জানান. আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ, বেলাবরের লটকন অনেক মিষ্টি ও সুস্বাদু হয় বলে এ লটকন বিক্রি করে লাভবান হওয়া যায়। এখানে ভালমানের লটকন পাওয়া যায়। দাম চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা মণ। এখানকার বিভিন্ন বাজার লটকন নিয়ে কুমিল্লায় বিক্রি করি। প্রতি কেজি বেশি দাম হলেও অধিক সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের অনেক চাহিদা রয়েছে। বেলাব উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা, নাজিম উর রউফ খান জানান, বেলাব উপজেলা লটকনের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে মাটি লাল ও পাহাড় আছে। এজন্য এর বৈচিত্র একটু বেশি। লটকন বেলাব উপজেলার একটি উচ্চ মূল্য ফসল। বেলাব উপজেলায় প্রায় ১৭৫ হেক্টর জমিতে লটকন চাষ হচ্ছে।