‘সুদ ব্যবসায়ীর হুমকির মুখে ঘর ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। ঘরে ফেরার উপায় নেই। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় আমার ঘরে এখন তালা ঝুলছে। মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছি না। ২৮ জুন সোমবার সকাল ১০ টায় সাংবাদিকদের কাছে নিজের সমস্যার কথা বর্ণনা দিচ্ছিলেন, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার ঘোলা গ্রামের দিনমজুর রবিউল ইসলাম। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, প্রতিবেশি ইদ্রিস শেখের কাছ থেকে তিনি ৪৬ হাজার টাকা সুদে আনেন। এর জন্য সুদের দ্বিগুণ টাকা তিনি পরিশোধ করেছেন। এরপরও সুদব্যবসায়ী তাকে চাপ প্রয়োগ করলে বর্তমানে তিনি ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় তার বাড়ির জায়গা দখলসহ ঘরে তালা লাগিয়ে দিয়েছে ওই সুদ ব্যবসায়ী ইদ্রিস শেখ। এ পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগী রবিউল ইসলাম চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসি জানান, কারেন্ট সুদের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এলাকার কতিপয় অসাধু লোক। মাকড়সার মতো জাল বিছিয়েছে তারা। আর এ জালে ধরা পড়ছে এলাকার সাধারণ দিনমজুর চাষিসহ নানা শ্রেণী পেশার লোক। করোনা কালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিসহ অনেকে কোন উপায়ান্ত না পেয়ে এসব সুদব্যবসায়ীদের কাছে থেকে কারেন্ট সুদে টাকা নিয়ে পরবর্তীতে তাদের সুদের জন্য গুণতে হচ্ছে কয়েকগুণ। এরপরেও ঋণ শোধ হচ্ছে না তাদের। শেষ পর্যন্ত অনেককে লিখে দিতে হচ্ছে নিজের বাস্তুভিটা। আবার অনেকে সুদকারবারীদের হুমকির মুখে নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। বাড়িঘর ছাড়ছেন কেউ কেউ। এলাকার অনেকের মতে করোনার চেয়ে ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করছে এসব সুদব্যবসায়ীরা। তারা সুদের টাকা আদায়ের জন্য হুমকি-ধামকির পাশাপাশি পাওনাদারের বাড়িতে গিয়ে মা-বোন ও স্ত্রীর সামনে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল ও মারধর করার কারণে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। গত ২০০০ সালের ১৯ জুলাই উপজেলার খড়মখালী গ্রামের হাসিকণা বিশ্বাস নামে এক স্কুল শিক্ষিকা সুদকারবারীদের হুমকির মুখে আত্মহত্যা করেন। এছাড়া চলতি মাসের ১৭ জুন টেলিভিশন ও বেতার শিল্পী উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামের মনোরঞ্জন বিশ্বাস সুদের টাকার চাপে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কালশিরা গ্রামের ভাস্কর্য শিল্পী রাম প্রসাদ বালার আত্মহত্যার জন্য প্রভাবশালী এক সুদব্যবসায়ীকে দায়ী করা হয়। পাশাপাশি কারেন্ট সুদের চাপে কালশিরা গ্রামের বাবু রাম ব্রহ্ম, অজয় বালা, কৃষ্ণ বালা ও বেন্নাবাড়ি গ্রামের মনোজ বিশ্বাস, বাবু বিশ্বাস, কালা বিশ্বাসসহ অনেকে দেশ ছেড়েছেন। বাড়িঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দলুয়গুনী গ্রামের আরিফুল শিকদার, ঘোলা গ্রামের জাকির হোসেন, একই গ্রামের মনজুর ফকিরসহ অনেকে। তাদের ঘরেও ঝুলছে তালা। চিতলমারী সদর ইউনিয়নে ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর মোল্লা জানান, সুদকারবারীদের জন্য এলাকার অনেকে ঘরছাড়া হয়েছে। তাদের হুমকিতে আত্মহত্যা করেছে অনেক লোক। এসব সুদ ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অনেকে কথা বলতে সাহস পায় না। তারা টাকা দিয়ে সব অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা কোন বিচার পায় না। করোনা কালীন সময়ে মানুষ নানা শঙ্কায় আছেন কিন্তু মনে হচ্ছে করোনার চেয়ে বড় ত্রাস এসব সুদব্যবসায়ীরা। ঘোলা গ্রামের ইদ্রিস শেখের সাথে কথা হলে তিনি সুদে টাকা দেওয়ার বিষয়য়ে জানান, রবিউল শেখের কাছে তিনি ধানের বিনিময় টাকা দিয়েছেন। রবিউল তার সাথে ঠিকমত লেনদেন না করার কারণে তার ঘরে তালা লাগিয়েছেন। তবে তালা লাগানোর জন্য তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে বড়বাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. মাসুদ সরদার জানান, রবিউলের বিষয়টি শুনেছি। পাওনা টাকার জন্য কারো ঘরে তালা লাগানো, বাড়ি দখল করা মোটেই ঠিক কাজ হয়নি। এ বিষয়ে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার একে এম আরিফুল হক জানান, এ জাতীয় সুদ ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের কোন ভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।