‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। গৌরবের ১০০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়ে ওঠার কথা ছিল গবেষণার কেন্দ্রস্থল। কিন্তু শতবর্ষে সেই আশা-আকাঙ্ক্ষা কতখানি পূরণ করতে পেরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে টিকা আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীর প্রাণ বাঁচাচ্ছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই দেখা যায়নি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করে থাকে। ২০১২ সালে কিউএস র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০০-এর ঘরে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অবস্থান নেমে যায় ৭০০-এর ঘরে। সম্প্রতি প্রকাশিত কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং ২০২২-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০১-১০০০-এর মধ্যে। আর দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ২০১ থেকে ২৫০-এর ঘরে। তবে ২০১৭ সালে উন্নতি হয়ে ১০৯ নম্বরে উঠে আসে। কিন্তু চার বছর যেতে না যেতেই আবার অবনতি হয়ে ১৩৫তম অবস্থানে নেমে গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়টি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে গবেষণার ক্ষেত্রে, শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে পড়ছে। দেশের চাকরির বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হচ্ছে নতুন নতুন বিষয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে।
একসময় দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল শিক্ষার্থীদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষার জায়গা। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখন অনেক শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দের তালিকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। বিশেষ করে দেশে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও ভালো করছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। শিক্ষক নিয়োগেও মেধাবীদের আকর্ষণ করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়টি।
গত দেড় বছর ধরে দেশ করোনা মহামারি মোকাবেলা করলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। শুরুর দিকে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করলেও কিছুদিন পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি অনলাইন ক্লাস চালানোর ক্ষেত্রেও মডেল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষপূর্তির গৌরব অর্জন করেছে। তবে অতীতের গৌরব বর্তমানে ঢাকা পড়েছে। ১৯২১ সালে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকরা শিক্ষক, গবেষকরা ছিলেন। বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয় জড়িয়ে আছে। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পরতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জড়িত ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধস নামতে শুরু করে এখন তলানিতে পড়েছে।’
তিনি বলেন, “তলানির সবচেয়ে বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের অপব্যবহার। শিক্ষা প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ পান বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞার জন্য নয়; রাজনীতির আনুগত্যের কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। আবার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গবেষণা না থাকলেও শিক্ষক রাজনীতি আছে। যার ফলে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ পদবাচ্য কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।”
গত ১০০ বছরেও শতভাগ আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বছর বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সেই হারে বাড়েনি আবাসনব্যবস্থা। ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসনের জন্য রয়েছে মাত্র ১৮টি হল। প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত হল নির্মাণ না হওয়ায় সংকট বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া হলগুলোতে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতা, রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর লাগামহীন হস্তক্ষেপ, অছাত্রদের দৌরাত্ম্যের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থা হুমকির মুখে। গ্রন্থাগার সুবিধাও অপ্রতুল। ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে মাত্র দুটি লাইব্রেরি রয়েছে। তবে লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত আসনব্যবস্থা নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় গ্রন্থাগারের বারান্দাগুলোতেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে দেখা যায়।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাথা নিয়ে শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে এগিয়ে চলছি। শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্র জোরদার করার জন্য ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’- সূত্র: কালের কণ্ঠ