বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী আর নেই সংস্কারে সরকারকে সহযোগিতা করা হবে যেন ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে: সেনাপ্রধান দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূতের সাথে বিএনপির বৈঠক টাকা ছাপালে সাময়িক স্বস্তি মিলবে, সমস্যার সমাধান হবে না: গভর্নর নতুন নারী প্রধানমন্ত্রী পেল শ্রীলঙ্কা চকরিয়ায় যৌথবাহিনীর অভিযান চলাকালে সন্ত্রাসী হামলায় সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম ছরোয়ার নির্জন নিহত মানিকগঞ্জে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক সভা নকলার নবাগত ওসিকে জামায়াতের ফুলেল শুভেচ্ছা পিরোজপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব গাজী ওয়াহিদুজ্জামান লাভলু’র বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপ্রপ্রচারের অভিযোগ শ্রীমঙ্গলে মিটার টেম্পারিং করে গ্যাস চুরির দায়ে মেরিগোল্ড সিএনজি পাম্প থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন

দেশের পরিসংখ্যানের সক্ষমতা ও মানের অবনতি

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৩ জুলাই, ২০২১

সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে চাল উৎপাদন নিয়ে দুই ধরনের হিসাব দিয়েছিল সরকারের দুই সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। সংস্থা দুটির হিসাবের গরমিলের কারণে অর্থবছরটিতে সঠিক সময়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগও করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। সে সময় দেশের সরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। একই প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংকও। সংস্থাটির পরিসংখ্যান সক্ষমতা ও মান পরিমাপক স্ট্যাটিস্টিকাল ক্যাপাসিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের স্কোর এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বনিম্নে ।

স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের গত বছরের স্কোর এসেছে ৬০। এখন পর্যন্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতায় এটিই বাংলাদেশের সর্বনি¤œ স্কোর। আগের দুই বছরে এটি স্থির ছিল ৬২ দশমিক ২২-এ। সূচকটির ঐতিহাসিক প্রবণতা বলছে, দেশের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০১৪ সালে। সে সময়ে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে প্রায় ৮০ পয়েন্ট স্কোর অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত অর্ধযুগে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা তীব্রতর হয়েছে।
তথ্যসূত্র ও উৎস, মেথডোলজি এবং সময়কাল এই তিন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি মূল্যায়ন করে বিশ্বব্যাংক। এক্ষেত্রে ২৫টি মানদ-ের বিপরীতে গড় স্কোর নির্ধারণ করে সংস্থাটি। এ স্কোর তৈরিতে দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রের তথ্যের সরবরাহ ও পদ্ধতিগত এবং সময়Íবিষয়গুলোর ওপর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সূচক, ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট বা জিডিপির হিসাব, লেবার ফোর্স সার্ভে, বাণিজ্য (আমদানি-রফতানি) এইচআইইএস, দরিদ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজস্ব ও মুদ্রানীতিবিষয়ক তথ্য, বাজেট, ব্যালান্স অব পেমেন্ট, সব বিভাগের আর্থসামাজিক তথ্য ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাংকের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোর কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিষয়টি অবশ্যই চিন্তার। তবে আমরা যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছি। এ খাতকে শক্তিশালী করতে ও দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। সরকারের এ খাতে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণও যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এর পরও স্কোর কমে যাওয়ার বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হবে।
মূলত তথ্যের উৎস দুর্বলতা, মেথডোলজিক্যাল দুর্বলতা বা মান নির্ধারণে দুর্বলতা, নির্ভুলতা ও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ করতে না পারার কারণেই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের তথ্যের মান দুর্বল হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি স্কোরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে শুধু আফগানিস্তান। দেশটির স্কোর ৫৭ দশমিক ৭৮। বাংলাদেশের সমান ৬০ স্কোর ভুটানের। এছাড়া ভারতের স্কোর ৭৬ দশমিক ৬৭, শ্রীলংকার ৮০ এবং পাকিস্তান ও নেপালের ৭২ দশমিক ২২। সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় ৬৯ দশমিক ৮১। পরিসংখ্যানগত সক্ষমতার মূল্যায়ন পদ্ধতির ক্ষেত্রে ২০১৪ সালে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৭০। এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে স্কোর কমছে। আর তিন বছর ধরে স্কোর ৩০। পরিসংখ্যানগত সক্ষমতার পর্যায়ক্রম ও সময়োপযোগিতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তিন বছর ধরে স্কোর ধারাবাহিকভাবে নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৭ সালে এ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৯০। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে যা ৭৬ দশমিক ৬৭-এ নেমে আসে। আর সর্বশেষ ২০২০ সালে সূচকটিতে বাংলাদেশের স্কোর আরো কমে ৭০-এ দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানগত সক্ষমতায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৮০। এর পর থেকেই স্কোর কমতে থাকে। সর্বশেষ ২০২০ সালে স্কোর হয়েছে ৬০।
রাষ্ট্রীয় নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নে (সিপিআইএ) পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতাকেও বিষয়ভিত্তিকভাবে রেটিং করেছে বিশ্বব্যাংক। এর মধ্যে সম্পত্তির অধিকার ও সুশাসন বিষয়ে রেটিংয়ে সর্বোচ্চ স্কোর ৬। এর মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ২০১৫ সালে ৩। এর পর থেকে সূচকটি কমে তিন বছর ধরে ২ দশমিক ৫ হয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ রেটিংয়ে ২০১০ সালে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল বাংলাদেশ। এ সময় স্কোর ছিল ৩। এরপর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। টানা আট বছর অর্থাৎ ২০১৮ সাল পর্যন্ত সূচকটিতে স্কোর ছিল ৩ দশমিক ৫, যা কমে সর্বশেষ ২০১৯ সালে আবার ৩ পয়েন্টে এসেছে।
লোকপ্রশাসনে এ মানের ক্ষেত্রে টানা কয়েক বছর ধরে সূচকটিতে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩, যা ২০১৭ সালে ২ দশমিক ৫-এ নেমে আসে। আর ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ স্কোরেই রয়েছে সূচকটি। অর্থবছরকেন্দ্রিক নীতিবিষয়ক রেটিংয়ে ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর্থিক খাতে এ রেটিংয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২ দশমিক ৫।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো জরিপ বা গবেষণার জন্য যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো সঠিকভাবে প্রশ্নপত্র তৈরি, তথ্য সংগ্রহকারীদের নিয়োজন, প্রশিক্ষণ, সুপারভিশন ও কার্যক্রমগুলোকে প্রি-টেস্ট করা। আবার খাদ্যসংক্রান্ত যে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় সেখানে খানার সদস্যরা কীভাবে তাদের খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ করছে, সেটি ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের পরিসংখ্যানে পিছিয়ে পড়ার কারণ হলো পরিসংখ্যানবিদদের দিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বিভাগ নামে যেটা আছে, সেটা এখন বন্ধ করে দিলেই বেশি ভালো হয়। পরিসংখ্যান বিভাগের কাজ করেন অন্য বিভাগের কর্মীরা। তাদের দিয়ে তো পরিসংখ্যান করা সম্ভব নয়। পরিসংখ্যানের দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে পরিসংখ্যানবিদ নিয়োগ দেয়ার পর তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি তো এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। অনলাইনে ঘরে বসেও বিদেশী প্রশিক্ষণগুলোতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব। বিষয়টিকে প্রয়োজনীয় করে তুললেই আমাদের পরিসংখ্যানের দুর্বলতা নির্মূল হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিভিন্ন সময়ে শুমারি, খানা আয়-ব্যয় জরিপ ও পরিসংখ্যানগত তথ্য প্রকাশ করে থাকে বিবিএস। তথ্যের উৎস ও পদ্ধতিগত সঠিকতা মেনে চললেও তা সময়মতো প্রকাশে বেশ দুর্বলতা রয়েছে সংস্থাটির। অন্যদিকে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট ও বেশকিছু খাতের তথ্য নিয়ে দুর্বলতা উঠে এসেছে। অনিয়মিত প্রকাশের কারণে সূচকের মানদ-েও পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১১ সালে অর্থনৈতিক শুমারি অনুষ্ঠিত হলেও পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ফলে দেরিতে প্রকাশের কারণে উপাত্তের গুরুত্ব অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে শস্য পূর্বাভাসে এখন রিমোট সেন্সিং ও স্যাটেলাইটের সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। ফলে দ্রুত সময়ে সঠিক তথ্য দিতে পারছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পুরনো পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সেক্ষেত্রে তথ্য দেয়া হলেও বেশ সময় লেগে যাচ্ছে।
জিডিপি, রাজস্ব ও মুদ্রানীতি, কর্মসংস্থান, উৎপাদন কিংবা ব্যয়সম্পর্কিত তথ্যগুলো মাসিক, ত্রৈমাসিক ও ষাণ্মাসিক আকারে প্রকাশ করা হয় উন্নত ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশেই। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ-সংক্রান্ত বার্ষিক যে তথ্য প্রকাশ করে তা-ও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে সেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি জরিপকারীদের স্বাধীনভাবে জরিপ করার ক্ষমতা দেয়াও প্রয়োজন বলে মনে করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি। আমাদের জরিপের পেছনে সময় লেগে যাচ্ছে বেশি। দেখা যায় কিছু জরিপ নিয়মিত করতে হয়। কিন্তু আমরা সেগুলো কয়েক বছর পর পর করি এবং এর ফলাফল আরো কয়েক বছর পরে প্রকাশ করি। এভাবে সময়ক্ষেপণের কারণে দেখা যায়, যখন জরিপের ফল হাতে আসে তখন মাঠের চিত্র অনেক বদলে যায়।
তিনি বলেন, পরিসংখ্যানের ফলাফলও অনেক ক্ষেত্রে সহজলভ্য হয় না। এতে পরিসংখ্যানের ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল তা নেয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশের পরিসংখ্যানগুলোর সার্বিক মানও প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, কখনো কখনো এমন জরিপও হয়, যা থেকে বাস্তব চিত্র উঠে আসে না। এসব বিষয়ে অবশ্যই নজর দিতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com