আমরা যে কোরবানি করছি তার ইতিহাস হজরত ইবরাহিম আ: ও পুত্র ইসমাইল আ: থেকে। যখন কোরবানির ঘটনা ঘটে তখন ইবরাহিম আ:-এর একমাত্র সন্তান হলেন হজরত ইসমাইল আ:। তাঁর পরবর্তী ছেলের জন্ম কোরবানির ঘটনার পরে। ঐতিহাসিক মতে, সে সময়ে ইসমাইল আ:-এর বয়স ছিল ১৪ বছর। এই বয়সে এবং একমাত্র ছেলে হওয়ায় ইসমাইল আ: ছিলেন ইবরাহিম আ:-এর বড় আদরের। ছেলে নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন, কত ভাবনা। এমনি সময়ে ইসমাইল আ:কে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে জবাই করার জন্য ইবরাহিম আ:কে স্বপ্ন দেখান। প্রশ্ন উঠে, সরাসরি কোরবানি করার হুকুম না দিয়ে স্বপ্নে দেখালেন কেন?
আল্লাহ যদি সরাসরি বলতেন, তুমি তোমার ছেলেকে কোরবানি করো। কোরবানি করা অর্থ গলা কেটে দেয়া। কিন্তু তিনি সরাসরি না বলে স্বপ্নে দেখান যে, জবাই করার জন্য কাত করে শোয়ায়ে দিচ্ছেন, ছুরি চালাচ্ছেন। ইবরাহিম আ: ঠিকই বুঝেছিলেন, তিনি তাঁর ছেলেকে জবাই করছেন বা গলা কাটছেন। কিন্তু আল্লাহর উদ্দেশ্য গলা কাটা নয়, তিনি দেখতে চান ইবরাহিম আ: কতখানি তাঁর আনুগত্য করতে প্রস্তুত।
নবীদের স্বপ্ন আল্লাহ দেখান এবং তা শতভাগ সত্য। শয়তান নবীদের স্বপ্ন দেখাতে পারে না। স্বপ্ন তিন প্রকারÑ খেয়ালি, শয়তানি ও রহমানি। মানুষ যা কল্পনা করে বা আশপাশে যা দেখে ঘুমের মাঝে সেটিই দেখে এবং এর নাম খেয়ালি। মানুষকে ভয় দেখানো বা গোমরাহ করার লক্ষ্যে যে স্বপ্ন তাকে শয়তানি স্বপ্ন বলে। যেমনÑ স্বপ্ন দেখাল, মাজারে মান্নত করলে তোমার ছেলের রোগ দূর হয়ে যাবে। এই স্বপ্ন দেখে গরু নিয়ে মাজারে গিয়ে জবাই করে দিলো। মোমিন ও সাধারণ মানুষকে স্বপ্নে আল্লাহ পাক অনেক সময় নির্দেশনা ও সুসংবাদ দান করেন এবং এই স্বপ্নকে বলে রহমানি স্বপ্ন।
হজরত ইসমাইল আ:কে স্বপ্নের কথা পিতা ইবরাহিম আ: এভাবে বলেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবাই করছি। এখন বলো, তোমার অভিমত কী? জবাবে ছেলে ইসমাইল আ: বলেন, আব্বাজান আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন।’ (সূরা আছ ছাফফাত-১০২)
জবাই করার উদ্দেশে যখন ইসমাইল আ:কে জবাই স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শয়তান তিন জায়গায় বাধা দেয়ার চেষ্টা করে এবং সে সময়ে পাথর ছুড়ে তিনি শয়তানকে বিতাড়িত করেন। হজের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে আল্লাহ পাক সেটি জারি রেখেছেন।
ইবরাহিম আ: ছেলেকে জিজ্ঞাসা করার অর্থ এ নয় যে, তিনি ছেলের মতামত চাচ্ছেন। বরং তিনি আল্লাহর কাছে চেয়েছিলেন এক নেক সন্তান। সত্যিই ইসমাইল আ: ছিলেন তাঁর নয়ন শীতলকারী সন্তান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তারা দুইজনই (পিতা-পুত্র) আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে (জবাই করার জন্য) কাত করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য প্রমাণ করেছ, নিঃসন্দেহে আমি সৎকর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কার দিয়ে থাকি। এটা ছিল তাদের উভয়ের জন্য একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি ছেলের পরিবর্তে একটি বড় কোরবানির জন্তু তাকে দান করলাম। (অনাগত মানুষদের মাঝে এভাবেই) তাঁর স্মরণকে আমি অব্যাহত রেখে দিলাম।’ (সূরা আছ ছাফফাত : ১০৩-১০৮)
পিতা-পুত্র উভয়ই আত্মসমর্পণ করলেন অর্থাৎ পিতা জবাই করতে এবং ছেলে জবাই হতে রাজি হয়ে গেলেন। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘এটি ছিল এক বড় ধরনের পরীক্ষা। আল্লাহ পাক তাঁর বান্দার মাঝে দেখতে চেয়েছেন আনুগত্য। পিতা-পুত্র তাতে শতভাগ সফল হয়েছেন। আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে এক জন্তু কোরবানির মাধ্যমে ইসমাইল আ:কে মুক্ত করে দেন এবং প্রতি বছর পশু কোরবানির মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের আত্মত্যাগের স্মরণ জারি করে দিলেন। এই কোরবানির মূল শিক্ষাই হলো আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেয়া। কোরবানির দিন আমরা ইবরাহিম আ:-এর আত্মত্যাগ স্মরণ করে পরিপূর্ণভাবে যদি আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারি তবেই আমাদের পশু কোরবানি সার্থক হবে। আমরা সারা বছর আল্লাহর নাফরমানি করি, কোরবানির দিনেও যদি আমাদের মধ্যে উপলব্ধি আসে এবং ফিরে আসি তা হলে আশা করা যায় আল্লাহ পাক অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। অন্যথায় এ থেকে আমাদের কোনো প্রাপ্তি ঘটবে না। এই কোরবানি আমাদের এ শিক্ষাই দেয় যে, আল্লাহর হুকুম পালনের ব্যাপারে একজন মুসলিম সামান্যতম অন্যথা করতে পারে না।
আল্লাহ ইসমাইল আ:-এর রক্ত প্রবাহিত করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন, ইবরাহিম আ: তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত কি না তা দেখতে। ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ: সফল হয়েছেন। আমরা তাঁর সন্তান হয়ে প্রতীকী পশু কোরবানির মাধ্যমে কোনো ধরনের দ্বিধা-সঙ্কোচ ছাড়াই লাখ টাকার গরু কোরবানি দিচ্ছি। কোরবানি উপলক্ষে আমরা কি পারি না আমাদের পশুটা হালাল অর্থে খরিদ করতে বা একটু ত্যাগ স্বীকার করে হারাম উপার্জন পুরোপুরি পরিহার করতে, তা হলে আল্লাহ আমাদের পেছনের গুনাহ ক্ষমা করে নতুনভাবে জীবনযাপনের তৌফিক দান করবেন ইনশা আল্লাহ।
কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা হজ-৩৭) আমরা পশু কোরবানি করি সেটির গোশত নিজেরা খাই, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর মাঝে বণ্টন করি। কোনো কিছু আল্লাহ গ্রহণ করেন না। আল্লাহ দেখতে চান বান্দার তাকওয়া। তাকওয়া প্রসঙ্গে এক দিন ওমর রা: উবায়েদ ইবনে কাব রা:কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনো কাঁটাদার গাছ-গাছালির মাঝ দিয়ে পথ অতিক্রম করেছেন। হ্যাঁ, সেটি হলো- মানুষ খুবই সতর্কতার সাথে কাঁটাদার গাছ এড়িয়ে রাস্তা অতিক্রম করে। পৃথিবীটা কাঁটাদার গাছে ভর্তি, হাজারো হারাম পথ রয়েছে। এসব মাড়িয়ে খুবই সন্তর্পণে বেছে বেছে চলার নামই তাকওয়া এবং যে এভাবে চলে সেই মুত্তাকি। দুনিয়াকে বাদ দিয়ে জান্নাতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকওয়া দুনিয়ার পাপ-পঙ্কিল পথ মাড়িয়ে সত্য পথে চলায় সহায়তা করে। একজন মুত্তাকি ব্যক্তি মানে গুনাহমুক্ত মানুষ। কোনো অন্যায়, পাপাচার বা যে কাজে সামান্যতম গুনাহ রয়েছে মুত্তাকি ব্যক্তি তা এড়িয়ে চলে। আমরা হাজারো গুনাহে যুক্ত এবং অনেক সময় গুনাহকে গুনাহ মনে করি না। যেমন, পর্দাহীনতা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে এবং এটি যে গুনাহ তা অনেকেই মনে করে না। অপ্রয়োজনে ও বিলাসিতা করে অনেকে ছবি উঠান ও মোবাইলে সংরক্ষণ করে, এটিও গুনাহের কাজ সে উপলব্ধি নেই; মসজিদের অজুখানায় পানির অপচয়, অপ্রয়োজনে ফ্যানগুলো চালু রেখে অপচয় করা সবই গুনাহ, কিন্তু এগুলো আমরা হালকা করে দেখি। একজন মুত্তাকি বান্দা কখনো কোনো গুনাহকে হালকা করে দেখে না। গুনাহ অর্থ আল্লাহর নাফরমানি। মুত্তাকি গুনাহমুক্ত বান্দা, সেসব ধরনের নাফরমানি থেকে দূরে থাকে। কোরবানি আমাদেরকে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও গুনাহমুক্ত জীবনযাপনের তাগিদ দেয়। এটি যদি সম্ভব হয় তবেই এই কোরবানি আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হতে সহায়তা করবে এবং জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত করবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সত্যিকার মুসলিম হওয়ার তৌফিক দান করুন।