মহামারীর আগে যেসব ব্যাংক গ্রাহকদের ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ৬-৯ শতাংশ সুদ দিত, তারাই এখন সুদহার দেড় শতাংশে নামিয়ে এনেছে। চলমান মহামারী শুরুর আগে আমানতের তীব্র সংকটে ছিল দেশের প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংক। বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত নিজ দখলে নেয়ার প্রতিযোগিতায় ছিলেন ব্যাংকাররা। কিন্তু মহামারী সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ দেশের ব্যাংক খাতে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। বিনিয়োগ-খরায় দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয়েছে অলস তারল্যের পাহাড়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতের সুদহার ইতিহাসের সর্বনি¤েœ নামিয়ে এনেছে। ২০১৯ সালের জুনে ব্র্যাক ব্যাংক ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সুদ পরিশোধ করত ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ। সেই ব্র্যাক ব্যাংক এখন গ্রাহকদের একই মেয়াদের আমানতের জন্য সুদ দিচ্ছে মাত্র ১ দশমিক ৫০ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ছয় মাস মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে এখন ব্র্যাক ব্যাংকের সুদহারই সবচেয়ে কম।
এ মুহূর্তে গ্রাহকদের ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ সুদ দিচ্ছে প্রাইম ব্যাংক। অথচ ২০১৯ সালের জুনেও ব্যাংকটি ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়েছে। ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য গ্রাহকদের সবচেয়ে কম সুদ দেয়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তালিকায় থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ইস্টার্ন, ডাচ্-বাংলা, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, দ্য সিটি, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। ব্যাংকগুলো আমানতের জন্য গ্রাহকদের সুদ দিচ্ছে দেড় থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ শতাংশ। নতুন ও দুর্বল ব্যাংকগুলো ছাড়া দেশের বেসরকারি অন্যান্য ব্যাংকও আমানতের সুদহার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। অথচ করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সর্বনি¤œ সুদও ছিল ৬ শতাংশের বেশি।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, মেয়াদি আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নেমেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই দেখা যায়নি। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ-খরা ও মহামারী সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগের কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের মুদ্রাবাজারে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অলস তারল্য। চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহার ৫০ পয়সার নিচে নেমেছে। বিনিয়োগের কোনো জায়গা না থাকার সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
মেয়াদি আমানতের এতটা কম সুদ কখনো দেখেননি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘নিরাপদ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের বিকল্প কোনো উৎস না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে ব্যাংক টাকা রাখছে। গত ৩৪ বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছি। কিন্তু ব্যাংকের মেয়াদি আমানতের সুদহার ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে এমনটি কখনো দেখিনি।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক এ চেয়ারম্যানের ভাষ্য হলো, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোয় বিপুল পরিমাণ অলস তারল্য আছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত পরিস্থিতিও একই। এ অবস্থায় গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি সুদে আমানত নিয়ে কী করব? বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন কোনো বিনিয়োগের জন্য গ্রাহকরা ব্যাংকে আসছে না। মুদ্রাবাজারে কলমানির সুদহার ১ শতাংশের নিচে। এজন্যই বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার এতটা নিচে নামিয়ে এনেছে। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে অতিরিক্ত তারল্যের এ চিত্র থাকবে না। বিনিয়োগ চাহিদা তৈরি হলে ব্যাংক খাতে আবারো তারল্য সংকট দেখা দেবে। তখন ব্যাংকগুলো আবারো বেশি সুদে আমানত নিতে বাধ্য হবে।
দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের প্রায় ৭৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে মোট আমানত আছে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা। ৫ কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে এ আমানত জমা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতের ৪৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ হলো মেয়াদি আমানত। মেয়াদি আমানতের সর্বনি¤œ সময় তিন মাস। অন্য সব শ্রেণীর আমানতের তুলনায় মেয়াদি আমানতের সুদহার সবসময়ই বেশি থাকে।
ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য ২০১৮ সাল থেকে তৎপর হয় সরকার। দফায় দফায় সুদহার বেঁধে দিয়ে ঋণ ও আমানতের সুদ কমানোর চেষ্টা করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু মুদ্রাবাজারে তারল্য সংকট থাকায় সুদহার নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা সফল হয়নি। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কার্যকর হয়। আর ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয় ৬ শতাংশ।
ব্যাংকগুলোকে আমানত ও ঋণের জন্য যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশ হারে সুদহার বেঁধে দিয়েছে সরকার। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই আমানতের সুদহার কমাতে থাকে ব্যাংকগুলো। পরবর্তী সময়ে করোনা সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ইতিহাসে সর্বনি¤েœ নামিয়ে এনেছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকার স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে এসব প্যাকেজের প্রথম দফা ঋণ বিতরণ প্রায় শেষও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হিসেবে এটিই সর্বনি¤œ। অন্যদিকে ঋণ প্রবৃদ্ধির ভাটার বিপরীতে অলস তারল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এ তারল্যের ৪৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ বা ৮৯ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা ছিল দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়।
২০১৯ সালের জুনে ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে ছয় মাস মেয়াদি আমানত নিয়েছে দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। চলতি বছরের জুনে ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে ব্যাংকটি। সিটি ব্যাংকে জমা আছে গ্রাহকদের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার আমানত। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭৭ শতাংশে।
আমানতের সুদহার সর্বনি¤েœ নামিয়ে আনাকে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা বলে মনে করছেন দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৬ শতাংশ। ঢাকা শহরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের যে সুদ দিচ্ছে, তা প্রবঞ্চনার মধ্যে পড়ে। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রবঞ্চনার পরিণতি ভালো হবে না। দেশে বিনিয়োগের পরিস্থিতি উন্নত হলে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের এ পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তখন আমাদের এ আমানতকারীদের কাছেই যেতে হবে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মাসরুর আরেফিন মনে করেন, সঞ্চয়ের দিক থেকে আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই বেশ পিছিয়ে। তার ওপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার যে পর্যায়ে নামিয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ আরো বেশি সঞ্চয়বিমুখ হবে। কস্ট অব ফান্ড কমে যাওয়ায় সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়বে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর প্রতিক্রিয়া হবে খুব খারাপ। ব্যাংকের ওপর আস্থা হারানো মানুষ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজবে। ফলে মানুষ আরো বেশি প্রতারণার শিকার হবে।
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানতের গড় সুদহার সবচেয়ে কম ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। বর্তমানে এ ব্যাংকটির আমানতের গড় সুদহার ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার আড়াই থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। রিটেইল ব্যাংকিংয়ে দাপট থাকায় আগে থেকেই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম ছিল। তার পরও ২০১৯ সালের জুনে ছয় মাস মেয়াদি আমানতের বিপরীতে গ্রাহকদের সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ সুদ পরিশোধ করত ব্যাংকটি। বর্তমানে কোনো শ্রেণীর আমানতের জন্যই সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে না ডাচ্-বাংলা।
কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে আমানতকারীরা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবেন বলে মনে করছেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঋণের সুদহার বেশি হলে উদ্যোক্তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। কারণ বিশ্বের কোথাও আমানত ও ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশের মতো সুদ পরিশোধ করা হয় না। বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলোয় বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোও আমানতের সুদহার কমিয়ে এনেছে। ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে বর্তমান পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ ও আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল প্রবীণ নাগরিকদের কথা চিন্তা করলে এটি খুব খারাপ। এক সময় ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রেখে মাসে ১ হাজার টাকা পাওয়া যেত। এখন ১ লাখ টাকা রেখে মাসে দু-তিনশ টাকা পেলে কেউ চলতে পারবে না।
দেশের ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে মেয়াদি আমানতে সবচেয়ে কম সুদ দিচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটি ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য সুদ দিচ্ছে দেড় থেকে আড়াই শতাংশ। যদিও ২০১৯ সালের জুনে ছয় মাস মেয়াদি আমানতের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক গ্রাহকদের ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করেছিল। বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন মেয়াদি আমানতের বর্তমান সুদহার মোটেই কাম্য নয়। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি। ব্যাংকগুলোর উচিত হবে মেয়াদি আমানতের সুদহার অন্তত মূল্যস্ফীতির বেশি দেয়া। সীমাতিরিক্ত তারল্যের কারণে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মুদ্রাবাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়া দরকার বলে মনে করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রণোদনার টাকা ছাড়া কোনো ব্যাংকই নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না। এ পরিস্থিতি ভালো লক্ষণ নয়। মুদ্রাবাজারের অতিরিক্ত তারল্য মূল্যস্ফীতিকেও উসকে দিচ্ছে। ঋণের চাহিদা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক হবে না। সরকারের দায়িত্ব হবে অতি দ্রুত জনগণের ঘরে ঘরে টিকা পৌঁছে দেয়া। লকডাউন দিয়ে দিয়ে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না।