কিছুদিন আগেও ভারতে কভিড সংক্রমণের বড় কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যটিতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যান রেকর্ড হয় মে মাসের শেষের দিকে। তবে রাজ্যটিতে মহামারী পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আড়াই মাস আগে রাজ্যটিতে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছিল। সেখানে গত বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় গোটা পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৭০০ জনের। মৃতের সংখ্যা নেমে এসেছে ছয়ে। পশ্চিমবঙ্গে কভিড পরিস্থিতিতে রীতিমতো ঈর্ষণীয় মাত্রায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির রাজ্য সরকার।
গোটা ভারতেই করোনার দাপট এখন আগের চেয়ে অনেক কম। তবে কভিডের ভয়াবহতা তুলনামূলক দ্রুতই সামলে উঠতে সক্ষম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার তাগিদে শুরু থেকেই প্রস্তুতি ও পদ্ধতিগত উপায়ে মহামারী মোকাবেলায় জোর দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। ফলে বর্তমানে সেখানে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের হারও নেমে এসেছে দেড় শতাংশের কাছাকাছিতে। শুরু থেকেই মহামারীকে মোকাবেলার পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটিও মোকাবেলা করতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। এজন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কভিড মোকাবেলায় গঠিত রাজ্যের উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান করেছেন একজন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদকে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জির নেতৃত্বে গঠিত এ বোর্ড এখন আসন্ন তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, কভিডে মৃত্যুহার কমাতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সেবার দিকেও নজর ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের। বয়সভিত্তিক দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের মা বা পরিচর্যাকারীর দৈনন্দিন খাদ্যতালিকাও ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের তৈরি করা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে যাতে বাইরে থেকে কভিডের সংক্রমণ নতুন করে প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়েও বেশ কড়াকড়ি চালু রয়েছে। অন্য রাজ্য থেকে রেলপথে পশ্চিমবঙ্গে আসার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় করোনা নেগেটিভের সনদ। বর্তমানে আকাশপথেও টিকার দুই ডোজ গ্রহণ অথবা কভিডের আরটিপিসিআর পরীক্ষায় নেগেটিভের সনদ ছাড়া কাউকেই পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
রাজ্যের নাগরিকদের টিকা নিশ্চিতের দিক থেকে এরই মধ্যে বেশ এগিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সম্প্রতি মমতা ব্যানার্জি দাবি করেছেন, দ্বিতীয় দফা টিকাদানের ক্ষেত্রে গোটা ভারতে পশ্চিমবঙ্গই সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। রাজ্যের ৯ কোটি মানুষের মধ্যে আড়াই কোটিকে এরই মধ্যে টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ লাখ তাদের দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে এ টিকাকরণ কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে তুলতে চাইছেন মমতা ব্যানার্জি। এ নিয়ে ভারতের কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে বারবার বিরোধেও জড়িয়েছেন তিনি। এছাড়া রাজ্যের নাগরিকদের জন্য আরো টিকা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছেন তিনি। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে বিষয়টি আবারো উত্থাপন করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে মমতা ব্যানার্জির সাম্প্রতিক বক্তব্য হলো, আমরা প্রতিদিন ১০ লাখ টিকা দেয়ার ক্ষমতা রাখি। সেটা ২০ লাখও হতে পারে। কিন্তু টিকা পেলে তো দেব। টিকাকরণে বেশ এগিয়ে গেলেও রাজ্যের নাগরিকদের এখনই সুরক্ষা বলয়ের বাইরে নিয়ে আসতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার। এরই মধ্যে কভিডের সংক্রমণ কমার লক্ষণ দেখা দিলেও তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সর্বশেষ এক বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকদের চলাচলে বিধিনিষেধের মেয়াদ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এ বিধিনিষেধ চলাকালে বিদ্যমান সান্ধ্য আইনও পুরোদমেই জারি থাকবে বলে জানানো হয়েছে। সান্ধ্য আইনের নিয়ম অনুযায়ী বর্তমানে প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা, আইনশৃঙ্খলা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও বিশেষ কিছু জরুরি সেবার সঙ্গে জড়িতরা ছাড়া অন্য কেউ রাস্তায় চলাচল করতে পারছেন না। গণপরিবহনের মধ্যে সাধারণ নাগরিকের জন্য শুধু মেট্রো সার্ভিস চালু রাখা হয়েছে সপ্তাহে পাঁচদিনের জন্য। এ পাঁচদিন সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে মেট্রো সার্ভিস। এছাড়া কর্মীদের সবার স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও টিকাকরণ নিশ্চিতের জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বাস্তবতা ও সম্ভাব্যতা অনুযায়ী কর্মীদের যথাসম্ভব বাড়িতে রেখে কাজ করাতেও বলা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এখন স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোদমে চালু করে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর সম্ভাব্য দিনক্ষণও ঘোষণা করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী দুর্গাপূজার ছুটি শেষে আগামী নভেম্বরে রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হবে। অন্যদিকে দীর্ঘ বন্ধের পর শিক্ষার্থীদের যাতে অনভ্যাসের কারণে বিপাকে পড়তে না হয় সেজন্য রাজ্যে আগামী বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাস কাটছাঁটের কথাও ভাবা হচ্ছে।