আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবদেন
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দি। স্কুলের মাঠে নেই তাদের ছোটাছুটি-খেলাধুলা, বন্ধুদের সান্নিধ্যও মিলছে না। ফলে তারা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মনের কথাও হয়তো পরিবারে শেয়ার করতে পারছে না। ক্লাসে অটো পাশ হয়ে যাচ্ছে, সেটাও হয়তো তাদের প্রত্যাশা ছিল না। তাছাড়া করোনাকালে অনেক অভিভাবকের চাকরি চলে গেছে, আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। চারপাশে আত্মীয়-পরিজনের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংবাদ। সবকিছু মিলিয়ে অনেকের মধ্যে হতাশা ও বিষণ্নতা বেড়েছে। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বেড়েছে, ৬১ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী বিষণ্নতায় ভুগছে। ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশের মানসিক চাপ অনেক বেড়েছে। আর ২১ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণের ভাবনায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায়।
করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। আঁচল ফাউন্ডেশনের দাবি, করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। মোট আত্মহত্যার মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ। তিনটি জাতীয়, ১৯টি স্থানীয় পত্রিকা, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুয়ায়ী, ২০১৯ সালে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছিল ১০ হাজারের বেশি।
লেখাপড়া ঠিকমতো না করায় বাবা-মায়ের বকাঝকার কারণে গত ২৯ মে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার (১৭) অভিমান করে আত্মহত্যা করে। গত ৭ জুন রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠায় পুষ্প আক্তার মনিকে (১৫) বকাঝকা করেন মা। অভিমানে ঐ দিনই আত্মহত্যা করে দশম শ্রেণির এই ছাত্রী। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ১৬ বছর বয়সি মুরছালিন মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে।
গত ১ জুন মা তাকে মোবাইলে খেলতে নিষেধ করেলে এবং একপর্যায়ে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিলে অভিমানে ৪ জুন মুরছালিন আত্মহত্যা করে। সে সিরাজগঞ্জ বেলকুচি উপজেলার সরকারি সোহাগপুর এস কে পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। এর পাঁচ দিন আগে একই ধরনের ঘটনায় অভিমান করে অতিরিক্ত গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে মারা যায় উল্লাপাড়া উপজেলার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ রাফি। গত ৩১ মে স্মার্টফোন নিয়ে মা-বোনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানুজ্জামান রাকিন।
এ প্রসঙ্গে অভিভাবক আশরাফুল ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে কোনো কিছু নিয়ে একটু চড়া স্বরে কথা বললেই কেঁদে অভিমান করে ভাত খায় না, সময়মতো গোসল করে না। সে কথা কথায় আত্মহত্যার হুমকি দেয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলেন, পিতামাতাকে শিশুদের মানসিকভাবে সহযোগিতা দিতে হবে। আর মানসিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া শিখতে হবে। যদি কোনো অভিভাবক দেখেন তাদের সন্তানের আচরণ হঠাৎ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তখন তাদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। এ ছাড়া এই সময়ে অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব স্কুল-কলেজে পড়ুয়া সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসের রোজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আরো গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হারে আত্মহত্যা বাড়ছে, সে হারে সচেতনতা কার্যক্রম নেই।