সাধারণত যেসব কর্মজীবী মানুষের আয় দৈনিক প্রায় ৩ ডলারের ওপর, তারাই মধ্যবিত্তের আওতায় আসে। এ হিসাব ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার ভিত্তিতে করা হয়। অপর একটি হিসাব হচ্ছে বাজার বিনিময় হারের বা মার্কেট এক্সচেঞ্জ রেটের ভিত্তিতে। আবার আয়ের দিক থেকে বিশ্বের মানুষকে সাধারণত পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। দরিদ্র, স্বল্প আয়ের মানুষ, মধ্য আয়ের মানুষ, উচ্চ মধ্যম আয়ের ও উচ্চ আয়ের মানুষ। যারা দিনে ২ ডলারের কম আয় করে তাদের দরিদ্র, দিনে ২ দশমিক শূন্য ১ থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত আয় হলে তারা নি¤œ আয়ের মানুষ, ১০ দশমিক শূন্য ১ থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত আয়ের মানুষেরাই মধ্যম আয়ের, ২০ দশমিক শূন্য ১ থেকে ৫০ ডলার আয় হলে উচ্চ মধ্যম আয়ের ও দিনে ৫০ ডলারের বেশি আয় হলে তারা উচ্চ আয়ের শ্রেণীর। এ আয় ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশে কৃষিবহির্ভূত খাত ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে কৃষির বাইরে কিছু মানুষ চলে আসছে। এ শ্রেণীর মানুষ হয় পড়ালেখা করে চাকরি করছে, না হয় কেউ ব্যবসা করছে, আবার কেউ কেউ স্বাধীন পেশা গ্রহণ করছে। এখন শুধু পরিবারের পুরুষ সদস্যই উপার্জনে যোগ দিচ্ছে না, তাদের সঙ্গে নারীরাও প্রায় সমহারে উপার্জনে অংশ নিচ্ছে। তবে শুরুতেই শিক্ষায় খুব বেশি এগিয়ে আসতে না পারলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরবর্তী প্রজন্ম এগিয়ে যাবে। এক সময়ে দেশের যে উচ্চবিত্ত শ্রেণী আছে, সেখানেও জায়গা করে নেবে এ নতুন শ্রেণীর মধ্যবিত্ত। ফলে এক প্রজন্ম পরই দেশে উচ্চবিত্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ১১তম। বর্তমানে ওই তালিকার ২৮তম অবস্থানে রয়েছে দেশটি। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশগুলোকে বাদ দিলে আগামী দশকে অন্য জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে মধ্যবিত্ত বৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষ তিনে থাকবে বাংলাদেশ। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আওতাভুক্ত। শ্রেণীটির বিকাশের মাধ্যমে দেশের সেবা খাতের চাহিদা ও ভোক্তার সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে স¤প্রসারিত হবে অর্থনীতির ক্ষেত্র। স¤প্রতি ওয়ার্ল্ড ডাটা ল্যাবের পরিসংখ্যানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, চলতি বছর একটি পরিবারে প্রতিদিন ১১ ডলার থেকে ১১০ ডলার খরচ করেছে এমন মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৩৭৫ কোটি। চীন ও ভারতে এ শ্রেণীর মানুষের আরো অন্তর্ভুক্তির কারণে আগামী ২০৩০ সালে মধ্যবিত্তের সংখ্যা আরো বাড়বে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় নতুন মধ্যবিত্ত যুক্ত হবে ৭ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ। এছাড়া পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯৫ লাখ, বাংলাদেশে ৫ কোটি ২৪ লাখ এবং ফিলিপাইনে ৩ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ যুক্ত হবে। অন্যদিকে মিসরে ২ কোটি ৯৬ লাখ, আমেরিকায় ২ কোটি ৪২ লাখ, ভিয়েতনামে ২ কোটি ৩২ লাখ, ব্রাজিলে ২ কোটি ৬ লাখ, মেক্সিকোতে ২ কোটি ১ লাখ মধ্যবিত্ত যুক্ত হবে। মধ্যবিত্তের এ বিকাশকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নতি ও অগ্রগতির পরিচায়ক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। কেননা বাংলাদেশে জনপ্রতি আয় ২ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমে ২০ শতাংশের কাছাকাছি এসেছে। যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে মধ্যবিত্তের উত্থানে। যারা আগে দরিদ্র ছিল, তাদের মধ্য থেকে একটি অংশ নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে যোগ দিচ্ছে। দরিদ্রদের বাইরে সিংহভাগ মানুষই আর্থিকভাবে সক্ষমতা অর্জন করেছে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তৎকালীন গবেষণা পরিচালক ও বর্তমান মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন ‘সাইজ অ্যান্ড গ্রোথ অব দ্য মিডল ক্লাস ইন বাংলাদেশ: ট্রেন্ডস, প্রোফাইলস অ্যান্ড ড্রাইভারস’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেন। সেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশের সেই সময়কার মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী বা ৩ কোটি ৬৮ লাখ মানুষ ছিল মধ্যবিত্ত। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। তবে ২০২৫ সালে তা ২৫ শতাংশে উন্নীত হবে ও ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মধ্যবিত্ত হবে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের প্রায় ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করেন। এছাড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ২২ শতাংশ। এক সময়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে। ২৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। বাংলা মাধ্যমে পড়ে দুই-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়ে। মধ্যবিত্তের মধ্যে আর্থিক খাতে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশ ভালো। ৯৬ শতাংশ মধ্যবিত্তের ব্যাংক হিসাব আছে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী ব্যাংকে স্থায়ী আমানত রাখে। প্রায় ১৭ শতাংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, আমার দৃষ্টিতে এখন দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই যে হারে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে, তাতে ধারণার চেয়ে বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক। শহর ও গ্রাম উভয় স্থানেই এ শ্রেণীর বিকাশ ঘটছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের কারণে অর্থনীতি বহুমুখী খাতের সম্মিলিত মাধ্যমে উন্নয়ন হবে। কয়েকটি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা থাকবে না। এছাড়া দেশের সুশাসনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রফতানি খাত ও কৃষি খাত বহুমুখী হবে। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চাহিদা অনুসারে সেবা নিশ্চিত ও স্বার্থ সংরক্ষণে পদক্ষেপ নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্যোক্তারা তাদের কষ্টার্জিত অর্থের মুনাফা যেমন প্রত্যাশা করবে, তেমনিভাবে নিয়ম-কানুনের পরিচ্ছন্ন বাস্তবায়ন চাইবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে দারুণভাবে সহায়ক হবে। তাই সেবা বিশেষ করে পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে না পারলে এ শ্রেণীর মানুষের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ হচ্ছে প্রধানত সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ছোট-বড় উপার্জনকারী ব্যবসায়ী/শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের উদ্যোক্তা। যত বেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হবে, তত বেশি অর্থনীতি টেকসই হবে। গণতান্ত্রিক মানসিকতার উন্মেষ হবে। এছাড়া মধ্যবিত্তের বিকাশের সঙ্গে সেবা খাতের চাহিদা বাড়ে, ভোক্তার সংখ্যা বাড়ে ও অর্থনীতির ক্ষেত্র স¤প্রসারিত হয়। ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের স¤প্রসারণ, খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন, হোটেল-রেস্তোরাঁয় গমনের অভ্যাস বেড়ে যাওয়া এবং বিদেশ ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের ফলে অর্থনৈতিক নীতিমালায় অনেক পরিবর্তন আসতে বাধ্য হবে। ব্যাংকিং ও বীমা খাতে এবং শেয়ারবাজারে মধ্যবিত্তদের ব্যাপক উপস্থিতির ফলে নীতিমালায় আসতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে মধ্যবিত্তের ভূমিকা বা গুরুত্ব কতটুকু? অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলোর ২০০৭ সালে বিশ্বের মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিয়ে করা গবেষণায় সেটি উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা মধ্যবিত্তের তিনটি ভূমিকার কথা বলেছিলেন। প্রথমত, মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই সাধারণত উদ্যোক্তা বেশি উঠে আসে। তারা সমাজে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, কর্মসংস্থান তৈরি করে। এছাড়া মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ মানব পুঁজি আহরণ ও সঞ্চয়ের ওপর জোর দেয়, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উপকরণ। মধ্যবিত্তরা দরিদ্রদের তুলনায় বেশি ভোগ করে এবং একটু বেশি গুণগত মানের পণ্য বা সেবা পেতে কিছুটা বেশি খরচ করতেও রাজি থাকে। এর মাধ্যমে মধ্যবিত্তরা বাজারে যে চাহিদা সৃষ্টি করে, তা বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের উত্থান হয়েছে। তবে সা¤প্রতিক সময়ে কভিড মহামারী ও আয়বৈষম্যের কারণে আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। এ শ্রেণীর যত দ্রুত বিকাশ হবে, ততই উৎপাদিত পণ্য, সৌখিন ও টেকসই পণ্যের চাহিদা বাড়বে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর শিল্পের বিকাশ হবে। দেশের উৎপাদনশীল ও দক্ষতানির্ভর প্রতিযোগী সক্ষমতা গড়ে তুলতে মধ্যবিত্ত ভূমিকা রাখবে জানিয়ে তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাজারনির্ভর প্রতিযোগী সক্ষমতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ দক্ষ জনশক্তির জোগান, রাজস্ব আয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা ছাড়াও শিল্পায়ন, সেবা খাতের স¤প্রসারণ করতে ভূমিকা পালন করবে।