মৌলভীবাজারে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বেরী লেইকের অর্ধেকটাই হয়ে গেছে বেদখল। এর ফলে ক্রমশঃ অস্তিত্ব হারাচ্ছে বেরী লেইক। এ লেইকের সৃষ্টি সম্পর্কে কোন দালিলিক তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। বর্তমানের পূর্ব প্রজন্মের প্রবীনরা অনেকে বলতেন- বেরী লেইক সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে। কোন এক ভয়াল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মনু নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করায় এ অংশটি পরিত্যক্ত হয়ে বেরী লেইক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার অনেকে বলতেন আমরা শুনেছি- বেরী লেইকটি মনু নদীর পরিত্যক্ত অংশ। ইতিপূর্বে এদিক দিয়ে মনু নদীর গতিপথ ছিলো। শহরটি ছিলো মনু নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড় বিস্তৃত। বর্তমান শাহমোস্তফা (রঃ) এর মাজারটিও ছিলো মনু নদীর উত্তর পাড়ে। শহরের দুটি অংশকে একত্রিতকরণ, যোগযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণ, মহকুমা প্রশাসনিক অবস্থান ও কার্যক্রম সহজীকরণ এবং শহর উন্নয়নের প্রয়োজনে নদীশাসনের মাধ্যমে মনু নদীর গতিপথ সোজা করা হয়। এর ফলে, মনু নদীর পরিত্যক্ত এ অংশটি বেরী লেইক নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে শাহমোস্তফা (রঃ) এর মাজারটি খলা পাড়ার (বর্তমান দরগা মহল্লা) বর্তমান স্থানে স্থানান্তর করা হয়। উভয় মতের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্কও ছিলো। তবে, উভয় মতদর্শীদের কেউই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেননা। তারাই বলতেন, এটা তাদের পূর্ব প্রজন্মের প্রবীনদের সূত্রে জ্ঞাত তথ্য। বিবেচ্য বিষয় হলো- প্রাকৃতিকভাবে অথবা মনু নদী শাসণে অথবা যে কারণে যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, বেরী লেইক মৌলভীবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি মূল্যবান সম্পদ, একটি দূর্লভ জলাধার। বেরী লেইকের পরিধি ছিলো এখনকার চেয়ে অনেক বড়। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সরকারী সম্পদ এ বেরী লেইকের আয়তন ছিলো প্রায় ১৪.৬৫ একর। জনশ্রুতি অনুযায়ী এর মূল চতুঃসীমা ছিল পূর্বে মুসলীম কোয়ার্টার বর্তমানে লেইক রোড, পশ্চিমে দর্জির মহল ও গোবিন্দশ্রী, পরবর্তীতে সিলেটি বাসস্ট্যান্ড রোড- যা বর্তমানে ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক, উত্তরে বর্তমান পুরাতন হাসপাতাল সড়ক ও দক্ষিণে খলা পাড়া (দরগা মহল্লা) বর্তমানে শাহমোস্তফা সড়ক। কিন্তু, বর্তমানে সেই চতুঃসীমা আর নেই। বর্তমানে আয়তন প্রায় ৭.৭৫ একর। বাকী প্রায় ৬.৯০ একরই চলে গেছে বিভিন্নজনের দখলে। শুধু দখলই নয়, সরকারী এ সম্পদ আশ্চর্য্যজনকভাবে ভূমি অফিসে রেকর্ডও হয়ে গেছে বিভিন্নজনের নামে। সরকারী সম্পদ বেরী লেইক ব্যক্তিবর্গের নামে রেকর্ড হলো কিভাবে, সে রহস্য অজানা। সংশ্লিষ্ট বিভাগের হাতে নেই এ তথ্য। বর্তমানে বেরী লেইকের উত্তর-পশ্চিম কোনের দোতলাবিশিষ্ট আয়াত উল্লা জামে মসজিদটি স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘসময় ছিলো ছোট একতলা মসজিদ। এ মসজিদটির সামনের বেরী লেইকে ছিলো মুসল্লীদের ওজু করার জন্য একটি পাকা ঘাট। সেসময় বেরী লেইকের পশ্চিম পাড় ও ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যবর্তী স্থানের দূরত্ব আনুমানিক সর্বোচ্চ ৫/৬ ফুটের বেশী ছিলোনা। এ মসজিদ থেকে দক্ষিণে এগিয়ে গিয়ে শাহমোস্তফা সড়কের প্রবেশমুখ পর্যন্ত লেইকের পশ্চিম পাড়ে কাচা-পাকা কোন ধরণের কোন স্থাপনা ছিলোনা। এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকালে নয়ণাভিরাম পুরো বেরী লেইকটি দেখা যেতো। স্বাধীনতার বেশ কিছু বছর পর একসময় এ মসজিদ থেকে শাহমোস্তফা সড়কমুখ পর্যন্ত স্থানে ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেষে বেরী লেইকের পশ্চিম পাড়ে আবর্জনা ফেলা শুরু করে পৌর কর্তৃপক্ষ। পুরো স্থানটুকু আবর্জনায় ভরাট হয়ে উঠলে, সেই আবর্জনার স্তুপ ঢেকে ফেলা হয় মাটি দিয়ে। এরপর শুরু হয় একের পর এক টিনশেড গৃহ নির্মান। এরপর ধীরে ধীরে সেসব টিনশেড গৃহগুলো একে একে পাকা দালানে রুপান্তরীত হয়ে আড়াল করে দেয় বেরী লেইক। এখন আর এ রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকালে বেরী লেইকটি চোখে পড়েনা। লেইকটির উত্তর পাড়ে ছিলো বেরীর চর নামে ছোট একটুকরো ভূখন্ড- যেখানে ঈদুল আজহা বা কোরবানীর ঈদ উপলক্ষ্যে একটি ছোটখাটো কুরবানীর গবাদি পশুর হাট বসতো। সেসময় কোন জনবসতি বা দোকানপাট ছিলোনা বেরী লেইকের কোন পাড়েই। বেরীর চর নামের ওই ছোট ভূখন্ডটি বর্তমানে একটি বিশাল ভূখন্ডে রুপ নিয়ে অনেকগুলো আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা সম্বলিত বিরাট একটি পাড়া/মহল্লায় পরিণত হলো কিভাবে, সে রহস্য অজানা। বর্তমানে বেরীর চর হয়ে উঠেছে শহরের সবচেয়ে বড় মহল্লা। বেরী লেইকের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত বর্তমান লেইক রোড সংলগ্ন অধিকাংশ স্থাপনাসমূহ, পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত বর্তমান ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন স্থাপনাসমূহ, উত্তর পাড়ে অবস্থিত বর্তমান বেরীরচর নামের মহল্লার অধিকাংশ স্থাপনাসমূহ ও দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত শাহমোস্তফা সড়ক সংলগ্ন একেবারে পশ্চিমাংশে বর্তমান বাসস্ট্যান্ড, বাস মালিক সমিতির কার্যালয়, এর উত্তর ও পূর্বের স্থাপনাসমূহ এবং একেবারে পূর্বাংশে সুলতানপুর চৌমোহনা সংলগ্ন স্থাপনাসমূহ গড়ে উঠেছে বেরী লেইক দখল ও ভরাট করা ভূমিতে। বেরী লেইকের অংশবিশেষ ক্রয়-বিক্রয়ও করা হয়েছে। ক্রয়কৃত বেরী লেইক ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে এমআর টাওয়ার নামে বহুতল ভবন ছাড়াও একাধিক আবাসিক ভবন। লেইকের দক্ষিণ পাড় ও শাহমোস্তফা সড়কের মধ্যবর্তী লম্বালম্বি আকার ভূমির পূর্ব ও পশ্চিম অংশে ছিল দুটি কবরস্থান। এ দুটি কবরস্থানের মধ্যবর্তী স্থানের মধ্যখানের বেরী লেইকে ছিলো একটি শান বাধানো ঘাট। এ শান বাধানো ঘাটসহ কবরস্থান দুটির মধ্যবর্তী পুরো স্থানটিতে সরকারীভাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো একটি শিশুপার্ক। বর্তমানে কবরস্থান দুটি টিকে থাকলেও, শান বাধানো ঘাটটির অস্তিত্ব বিপন্ন। আর, শিশুপার্কটি হয়ে গেছে বেদখল। একাধিক বাঁশের আড়ৎ, আবাসিক কলোনী, ট্রাক স্ট্যান্ড, ট্রাক মালিক সমিতির অফিস, ছাগলের হাট, আরসিসি ম্যানুফ্যাকচারিং, ইটের স্তুপ, টং দোকান, পাথরস্তুপ ইত্যাদির দখলে চলে গেছে পুরো শিশুপার্কটি। লেইকটির চারিদিকে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। লেইক পাড়ের বিভিন্ন বাসাবাড়ীর টয়লেটের সেফটি ট্যাংকের দূষিত পানিও নির্গত করা হচ্ছে লেইকে। এছাড়া, লেইকের পাড় ঘেঁষে গজানো বিভিন্ন জাতের জলজ ঘাস, কচুরিপানা ও আগাছা তো রয়েছেই। এভাবেই কর্তৃপক্ষের অযতœ-অবহেলা আর বেদখলে বেরী লেইকটি ক্রমশঃ অস্তিত্ব হারিয়ে মৃতঃপ্রায় হতে চলেছে। বেরী লেইকটি মৌলভীবাজার পৌরসভার নিয়ন্ত্রনে ছিলো এবং এখনও রয়েছে। বেরী লেইকের এসএ নকসা, এসএ রেকর্ডসহ আয়তন, চতুঃসীমা ইত্যাদির সকল তথ্য ও সকল কাগজাত পৌরসভার হাতে রয়েছে। অতীতে মাছ চাষের জন্য অনেক বছর ইজারা দিয়ে পৌরসভা অনেক টাকা উপার্জন করেছে। অথচ, শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মূল্যবান জলাধার এ বেরী লেইকটির ব্যাপারে পৌর কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে নির্বিকার- যদিও গত পৌর নির্বাচনকালে মেয়র ফজলুর রহমান বলেছিলেন বেরী লেইকটিকে মৌলভীবাজারের হাতিরঝিলে রুপান্তর করবেন।