রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০০ পূর্বাহ্ন

সনাতনী ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরায় পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হচ্ছে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

জার্মানিভিত্তিক এক পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রধান উৎস ছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ চলতি মৌসুমেও এখান থেকে বেশকিছু চালান নেয়ার পরিকল্পনা ছিল ওই জার্মান ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের। কিন্তু ক্রেতাদের রুচি বদলের কারণে শেষ পর্যন্ত বড় একটি চালানের পণ্য নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরের চালানগুলোয় নতুন ডিজাইনের পণ্য প্রস্তুতের জন্য প্রতিষ্ঠানটি এখানকার এক কারখানার সঙ্গে যোগাযোগও করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশী কারখানার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওই নকশা অনুযায়ী ক্রেতার কাছে চালান পৌঁছাতে সময় লাগবে ৯০ দিনেরও বেশি। এ অবস্থায় ভিয়েতনামের একটি কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করে জার্মান ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটি। ভিয়েতনামি কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই ডিজাইনের পণ্য সরবরাহে তারা সব মিলিয়ে সময় নেবে ৬০ দিন। দ্রুত পণ্য হাতে পাওয়ার তাগিদ থেকে শেষ পর্যন্ত ওই ভিয়েতনামি কারখানায়ই ক্রয়াদেশ দিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পোশাক পণ্যে ক্রেতার চাহিদামতো লিড টাইম (রফতানি পণ্য সরবরাহে নেয়া সময়) অনুসরণ করতে পারছে না বাংলাদেশী রফতানিকারক কারখানাগুলো। উৎপাদন প্রকৌশলে জোর দেয়ার পরিবর্তে সনাতনী ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরে থাকার কারণে এসব কারখানা এখন প্রতিযোগী সক্ষমতা হারাচ্ছে। প্রথাগত ব্যবস্থা আঁকড়ে থাকায় অনুৎপাদনশীলভাবে সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি প্রকৌশলগত পরিকল্পনায়ও থেকে যাচ্ছে অদক্ষতার ছাপ। নতুন একটি ডিজাইনের পণ্য উৎপাদন শুরুর আগে সেটি আত্মস্থ করতে গিয়েই অনেক সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। এতে করে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পণ্যও পৌঁছাচ্ছে অনেক দেরিতে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চের (এনআইটিইআর) এক শিক্ষকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। গুণগত ও পরিমাণগত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে করা ওই গবেষণায় পাওয়া ফলাফল প্রকাশ হয়েছে ‘অ্যান ইম্পেরিকাল স্টাডি অন লিড টাইম অব রেডিমেড গার্মেন্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। এক্ষেত্রে আগেকার সংশ্লিষ্ট একাধিক গবেষণা ছাড়াও খাতটির উৎপাদন সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বাস্তব অভিজ্ঞতাও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এতে দেখা গিয়েছে, অদক্ষ কর্মী, অনুৎপাদনশীল সময় বা কৌশলগত দুর্বল সিদ্ধান্তের কারণে পণ্যের উৎপাদন পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধাপে নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। প্রডাকশন লাইনে নিয়োজিত কর্মীরা দক্ষতা অর্জন করেন মূলত নিজ চেষ্টা ও অভিজ্ঞতার (ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বেসিস) ভিত্তিতে। আবার কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ দুর্বলতার কারণেও নানা সংকট তৈরি হয়। এছাড়া ব্যবস্থাপক ও পণ্য উৎপাদনকারী কর্মীদের মধ্যে প্রকৃত তথ্য ভাগাভাগিতেও করে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। উৎপাদনে দক্ষ পরিকল্পনা করতে না পারার এটিও একটি কারণ। বিষয়টি অস্বীকার করছেন না পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরাও। তাদের দেয় তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরাসরি রফতানি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত কারখানাগুলোর মধ্যে শিল্প বা উৎপাদন প্রকৌশলের (ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং) ধারণার প্রকৃত বাস্তবায়ন করছে সাকল্যে ৫০০ কারখানা।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, ঘণ্টায় যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন হওয়ার কথা, সে পরিমাণে হচ্ছে না। নিয়োগের সময় কর্মীদের দক্ষতা পরিমাপ করার জন্য তাদের হাতে নির্দিষ্ট একটি টি-শার্টের নকশা দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, এটি ঘণ্টায় কত পিস উৎপাদন করা সম্ভব হবে? এক্ষেত্রে কর্মী যে সংখ্যার কথা বলছেন, তা তিনি পারছেন না। আবার ক্রেতার নকশার ধরনও এখন অনেক। এ দুই প্রেক্ষাপটেই উৎপাদনের গতি অনেক শ্লথ হয়ে পড়ে। আবার দেশে সক্রিয় কারখানাগুলোর বড় অংশেই প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চর্চা নেই। ফলে পরিকল্পনা পর্যায়েই অদক্ষতার অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত এ পরিকল্পনা অদক্ষতাই ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী লিড টাইম বজায় রাখতে না পারার বড় কারণ হয়ে ওঠে।
বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আগে উৎপাদন প্রকৌশল বা প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চর্চা পোশাক শিল্পের কারখানায় ছিল না। এখন এ ধরনের উৎপাদনগত প্রকৌশলে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারা একটি নকশা করে মেশিনে কয়টা লে-আউট দিতে হবে, এ ধরনের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে। ঘণ্টায় বা মিনিটে কতখানি উৎপাদন সম্ভব, তা-ও প্রাক্কলন করতে পারছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে এখন প্রডাকশন সাজানো হচ্ছে। তবে প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ধারণাটি সর্বোচ্চ ৫০০ কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে। শিল্পের সব কারখানায়ই এ চর্চা শুরু হলে ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছার লিড টাইম আরো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য জাহাজীকরণ থেকে শুরু করে ক্রেতার হাতে পৌঁছার লিড টাইম বজায় রাখতে না পারার প্রথম কারণটিই হলো পরিকল্পনায় অদক্ষতা। পোশাক পণ্যের নমুনা তৈরির পর্যায় থেকেই এর সূত্রপাত। এসব নমুনা তৈরিতে ক্রেতার চাহিদা বোঝার ক্ষেত্রেও দুর্বল পরিকল্পনা ও বোঝাপড়ার ঘাটতি দেখা যায়। ফলে নমুনাগুলোও একাধিকবার বাতিল হয়। একই কারণে আবার নমুনা অনুমোদন পাওয়ার পর উৎপাদনে গেলেও পণ্যে ত্রুটির মাত্রাও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অনেক কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শেষ করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন গুণ বেশি সময় লেগে যায়।
এ বিষয়ে পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে লে-আউট করার মতো বিষয়গুলোয় আমরা এখন অনেক মনোযোগী। একটা সময় এক্ষেত্রে লাগছে এটা ঠিক। এটা আরো কমানো সম্ভব ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে। ছোট কারখানাগুলোয় এ-সংক্রান্ত বিভাগ নেই। কিন্তু বড় ও কিছু মাঝারি কারখানায় এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং আছে। এ কারখানাগুলোয় এখন পরিকল্পনার ক্ষেত্রটি আরো উন্নত করতে হবে। বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। ফলে এ বিষয়ে উন্নতির কাজ অনেক দ্রুতই এগিয়ে নেয়া যাবে। তবে পাশাপাশি এটাও বাস্তবতা যে লিড টাইমের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রক্রিয়াগত সময়ক্ষেপণ বড় প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। রফতানি-সংশ্লিষ্ট নথি তৈরি থেকে শুরু করে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও পণ্য পরিবহনের মতো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের অনেক কারণও রয়েছে। সবগুলো ক্ষেত্র উন্নত করার কাজ আমরা করছি।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অদক্ষ পরিকল্পনা ছাড়াও ক্রেতার চাহিদামাফিক লিড টাইম বজায় রাখতে না পারার আরেকটি বড় কারণ হলো প্রথাগত উৎপাদন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় পোশাকের বিভিন্ন অংশ কাটার পর তা স্তূপ আকারে জমা থাকে সুইং শাখায়। এসব আলাদা করে পরবর্তী সময়ে যথাযথভাবে বিতরণের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। এ ধরনের জটিলতা নিরসন করে উৎপাদনের গতি বাড়ানো প্রডাকশন সুপাইভাইজারদের জন্য সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। অকার্যকর এ পন্থায় এক একটি নকশা অনুযায়ী চূড়ান্ত পণ্য তৈরিতেও সময়ক্ষেপণ হয়। সার্বিকভাবে প্রডাকশন ম্যানেজারের পক্ষে যথাযথ উৎপাদন ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয় না। বড় সমস্যা হলো এ ধরনের প্রথাগত ব্যবস্থাতেই বেশির ভাগ কারখানা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট অনেকের মধ্যে অনীহা রয়েছে।
এ বিষয়ে উল্লিখিত গবেষণা পরিচালনাকারী এবং এনআইটিইআরের শিক্ষক ও গবেষক আবির খান বলেন, বাংলাদেশে পোশাক খাতের লিড টাইম বজায় রাখার সমস্যা নিয়ে দুটো বিষয় উল্লেখযোগ্য। একটি হলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অদক্ষতা। এ ধরনের কাঠামোর ব্যাপ্তি দেশের পোশাক খাতে ব্যাপক না। বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায়, ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দেয়ার আগে যখন স্যাম্পল ডেভেলপমেন্ট বা নমুনা উন্নয়নের কাজ দেয়, তখন বাংলাদেশের কারখানায় অনেক বেশি সময় নেয়া হয়। দেখা যায় একটা ক্রয়াদেশ ক্রেতা দিতে চাচ্ছে জানুয়ারি মাসের জন্য, কিন্তু নমুনায় বারবার ভুল হওয়ায় ফেব্রুয়ারি, মার্চ পর্যন্ত সময় নষ্ট হয়। এতে করে লিড টাইম বেড়ে গিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে ক্রয়াদেশ হারাতে হয়। ক্রেতারা একই পণ্যের নমুনা তৈরির কাজ একাধিক দেশে দিয়ে থাকেন। যে দেশ যত দ্রুত নমুনা তৈরি করে অনুমোদন নিতে পারে, সেই দেশেই ক্রয়াদেশ দেয়া হয়। সার্বিকভাবে ক্রয়াদেশ ধরার প্রাথমিক ধাপেই যে দক্ষতা বা নৈপুণ্য প্রয়োজন সে জায়গাটিতে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। এরপর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঘাটতিতে লিড টাইম বজায় রাখা যাচ্ছে না বাংলাদেশে। ধারণাটি বাংলাদেশে এখনো নতুন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com