রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ন

পশুখাদ্যের দাম বাড়ায় লোকসানে ক্ষুদ্র মাঝারি খামারিরা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২১

বিশ্বজুড়ে কভিড-১৯ মহামারীর কারণে একটা দীর্ঘ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে ছিল। ক্রমাগত লোকসানের মুখে নতুন করে বিনিয়োগ বন্ধ ছিল অনেক খাতেই। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর অন্য অনেক খাতের মতো বাংলাদেশের পশু ও দুগ্ধ উৎপাদন শিল্পেও বিনিয়োগ শুরু হয়। প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ছাড়াও ছোট-মাঝারি খামারিরা দুধ ও মাংস উৎপাদনে মনোযোগী হন। কিন্তু বাজারে পশুখাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বিপরীতে বাড়েনি দুধ ও মাংসের দাম। ফলে লোকসানে দুধ বিক্রির কারণে অনেকে নতুন করে পুঁজি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন।
এমনই একজন চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকার মেসার্স এসএআই এগ্রোভেটের খামারি মো. অলি উদ্দিন। গত পাঁচ বছর ধরে গরুর খামার পরিচালনা করছেন তিনি। দেশীয় গরুর পাশাপাশি দৈনিক গড়ে ১০০ কেজির বেশি দুধ বিক্রি করতেন তিনি। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে লোকসানে ছিল তার খামার। এরপর যখন বিধিনিষেধ উঠে গেল তখন সামনে এলো নতুন সমস্যা। আর সেটি হলো পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। মাংস ও দুধের দাম উৎপাদন খরচের তুলনায় না বাড়ায় খামার বন্ধ করে দেয়ার উপক্রম হয়েছে এ তরুণ উদ্যোক্তার।
একই অবস্থা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামারিদের। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ছাড়াও শিপিং চার্জ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে সারা দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিরা সংকটে পড়েছেন।
চট্টগ্রামের একাধিক খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি লিটার দুধ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। প্রতিদিন একটি গাভীকে যে পরিমাণ খাবার খাওয়াতে হয়, তার হিসাবে এ দামে দুধ বিক্রি করলে লাভ হয় খুবই কম। অন্যদিকে গত কয়েক মাস ধরে দেশের বাজারে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। ওষুধসহ খামার পরিচালনায় বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে গেলেও কমেছে কেবল দুধের দাম। খরচ অনুপাতে বাড়েনি মাংসের দাম। আবার গত কোরবানির ঈদেও বেশির ভাগ খামারি ন্যায্য মূল্য পাননি। অনেক গরু অবিক্রীত রয়ে যায়। সব মিলিয়ে পরিচালন ব্যয় নিয়ে সংকটে পড়েছেন খামারিরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী পাইকারি বাজারের বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় চিকন ভুসি হিসেবে পরিচিত পশুখাদ্য বস্তাপ্রতি (৫৫ কেজি) ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে দাম বেড়ে ১ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পাতা ভুসির দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৯০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪০০ টাকায়, ভুট্টা প্রতিকেজি ২০ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা, খৈল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১ হাজার ৭০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩৫০ ও ধানের কুঁড়া বস্তাপ্রতি (৪০ কেজি) ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়াও কেজিপ্রতি সয়ামিল আগে ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ৪৭ থেকে ৪৮ টাকায়, মসুর ডালের ভুসি (৩০ কেজি) ৩০০ টাকা বেড়ে ৯৫০ টাকায়, মুগডালের ভুসি ২০০ টাকা বেড়ে বস্তাপ্রতি (৪০ কেজি) ১ হাজার ৪৬০ টাকায়, ছোলার ভুসি (২৫ কেজি) প্রায় সমপরিমাণ বেড়ে ১ হাজার ৩২০ টাকায়, আটা কুঁড়া (৫০ কেজি) ২৫০ টাকা বেড়ে বস্তাপ্রতি ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪২০ টাকায়, চালের খুদ (৫০ কেজি) বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৩৮০ থেকে ১ হাজার ৪২০ টাকায়, সয়াবিনের ছাল বস্তাপ্রতি (৩৫ কেজি) ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সিংহভাগ পশুখাদ্যের চাহিদা মেটে স্থানীয় উৎস থেকে। তবে সাধারণত বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করা পশুখাদ্য দিয়ে খামার পরিচালনা করে। বর্তমানে শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়ায় আমদানি করা পশুখাদ্যের আমদানিমূল্য অনেক বেড়ে গেছে। যার কারণে বড় খামারগুলোও দেশীয় পশুখাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। যার প্রভাবে এসবের দামও বাড়ছে। তাছাড়া পশুখাদ্য তৈরির প্রায় সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচের কারণে পশুখাদ্যের বাজার অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ফলে উচ্চমূল্যে পশুখাদ্য কিনলে দুধ কিংবা মাংস উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়। কিন্তু বর্তমান বাজারে দুধের দাম না বেড়ে বরং কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর খামারিরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার খামারি সুদীপ্ত সাহা বলেন, পশুখাদ্যের বাজার প্রতি মাসেই বাড়ছে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর দুধের সরবরাহ বাড়লেও দাম বাড়ছে না। চিনি, ভোজ্যতেল ও আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় বেকারি পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। যার কারণে উৎপাদিত দুধও সময়মতো বিক্রি করা যাচ্ছে না। মিষ্টিজাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দুধ কিনলেও আগের তুলনায় কম দাম দিচ্ছেন। যার কারণে ছানা তৈরি করে তা বিক্রির মাধ্যমে খামার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। এভাবে চলতে থাকলে লোকসানে যেকোনো সময় খামার বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানান এ খামারি।
এগ্রোটেক পোলট্রি অ্যান্ড অ্যানিমেল ফুডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. শাহজালাল বলেন, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশে পশুখাদ্যে সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। এক বছর আগেও প্রতি টন পণ্যের শিপিং চার্জ ছিল মাত্র ৫০০ ডলার। বর্তমানে চীনের আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতায় শিপিং চার্জ তিন গুণ বেড়েছে। এতে আমদানি মূল্যের চেয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া সা¤প্রতিক সময়ে দেশে একই কারণে চাল, ডাল ও গমের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় পশুখাদ্য উৎপাদনকারীরাও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
জানা গেছে, দেশে পশুখাদ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ভুট্টা। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকেই এসব ভুট্টা সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও ভুট্টা আমদানি করা হয়। তবে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় বেড়ে যাওয়ার পর বিশ্ববাজার থেকে ভুট্টা সংগ্রহ ধীরগতিতে হচ্ছে। ফলে চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ না থাকায় পণ্যটির দাম বেড়েই চলেছে। কানাডা থেকে ভুসি আমদানি হলেও বর্তমানে শিপিং কোম্পানিগুলোর চীননির্ভর বুকিংয়ের কারণে দেশে যেকোনো পণ্য আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের পশুখাদ্যের বাজারে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী পাইকারি বাজারের মেসার্স দীপক স্টোরের স্বত্বাধিকারী রুবেল মজুমদার বলেন, প্রতি মাসেই পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। মিল পর্যায় থেকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কথা বলে পাইকারি পর্যায়েও বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে আমদানীকৃত পশুখাদ্যের সরবরাহ কিছুটা কমে যাওয়ায় বাজারে কৃত্রিম সংকট ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।-সূত্র: বণিকবার্তা অন লাইন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com