রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩১ অপরাহ্ন

মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু

মাওলানা এম এ হালিম গজনবী এফসিএ:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১

পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার শীর্ষস্থানীয় পছন্দনীয় সর্বকালের মানবজাতির তিনটি সর্বোচ্চ গুণাবলি হলো- তাকওয়া, ঈমান, ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করা অর্থাৎ মুত্তাকি, মুমিন ও মুসলিম হওয়া। ‘তাকওয়া’ বা ‘আল্লাহভিরুতার’ অসাধারণ তাৎপর্য ও অন্যতম সর্বোচ্চ গুণের চূড়ান্ত প্রমাণ- পবিত্রতম কুরআনের প্রথম পারা শুরু হয়েছে তাকওয়া, ঈমান ও ইসলাম উল্লেখ করে। যথা- আল্লাহর বাণী, ‘আলিফ, লাম, মিম। এ কিতাব, এতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই, এ কিতাব পথপ্রদর্শক সেসব খোদাভীরু বা মুত্তাকি লোকদের জন্য। যারা অদৃশ্য বিষয়সমূহে বিশ্বাস করে এবং নামাজ কায়েম করে আর তাদেরকে যে উপজীবিকা প্রদান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে সেই কিতাবের প্রতি যা, আপনার (রাসূল সা:) প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, আর সেই কিতাবের প্রতিও যা, আপনার আগে নাজিল হয়েছে। আর আখিরাতকে যারা সুনিশ্চিত বিষয় বলে বিশ্বাস করে। তারাই রয়েছে তাদের প্রতিপালকের হেদায়েতের ওপর আর তারাই হবে সফলকাম।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১-৫)
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, উপরি উক্ত মাত্র পাঁচটি আয়াতে, মুত্তাকিগণকে অবিলম্বে আল্লাহ পথ দেখালেন মুমিন ও মুসলিম হওয়ার জন্য। মুমিন হওয়ার জন্য অদৃশ্য সত্তা ও বিষয়সমূহকে যথা- আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাগণ, পরকাল, তাকদির, মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে বিশ্বাস করতে হবে এবং মুসলিম হওয়ার জন্য মুত্তাকিকে আদায় করতে হবে সালাত, দিতে হবে জাকাত, দান-সদকা-খয়রাত এবং পালন করতে হবে অন্যান্য করণীয় কর্মকা-সমূহ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর আদেশ মোতাবেক এবং বর্জন করতে হবে সব নিষিদ্ধ কাজগুলো।
তাকওয়া মানে আল্লাহভিরুতা, ভয় করা আল্লাহকে এবং তাঁর তরফ থেকে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, আজাব-গজব বা কঠোর শাস্তি ও ধ্বংসলীলাসমূহকে যথা- জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন, দাবানল, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি।
আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তাকওয়া অবলম্বনের এবং নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করার ওপর। আল্লাহর বাণী, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১০২) আল্লাহকে ভয় করার আদেশটি অবশ্যই কঠোর, ‘যথাযথভাবে’ উচ্চারণ করার কারণে। ফলে এ আদেশটি মান্য করা মুমিন মুসলিমদের জন্য বর্ণানাতীত অত্যাবশ্যক। হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনার এ কঠোর আদেশ পালন করার তাওফিক দয়া করে দান করুন।
তাকওয়ার তাৎপর্য, গুরুত্ব, অবদান, উপকারিতা ইত্যাদি অসাধারণ অবর্ণনীয় যথা- আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্ত ও তাঁর সাথী হওয়া যায়, বিপদাপদ ও সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, কর্মকা- সহজ হয়ে যায়, আল্লাহর কাছে সম্মানিত হওয়া যায়, পাপ মোচন হয়, মহা পুরস্কার পাওয়া যায়, ন্যায়-অন্যায় বোধগম্য হয়, আল্লাহর ক্ষমা পাওয়া যায় ইত্যাদি যা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, অনুধাবনযোগ্য এবং স্মরণে রাখার মতো।
উপরি উক্ত বিষয়াবলির সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো নি¤েœ আলোচনা করা হলো-
‘নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন’। (সূরা তাওবা, আয়াত-৭)
‘জেনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথেই রয়েছেন’। (সূরা তাওবা, আয়াত-৩৬)
‘অতঃপর যারা মুমিন ও মুত্তাকি ছিল, তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছি (সালেহ আ:-এর ধ্বংসপ্রাপ্ত অঞ্চল থেকে)’। (সূরা নামল, আয়াত-৫৩)
‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার (সঙ্কট থেকে বের হওয়ার) পথ বের করে দেন’। (সূরা তালাক, আয়াত-২)
‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজকর্ম সহজ করে দেন’। (সূরা তালাক, আয়াত-৪)
‘নিশ্চয় আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে তারাই বেশি সম্মানিত, যারা বেশি আল্লাহভীরু’। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১৩)
‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার পাপ মোচন করবেন এবং তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন’। (সূরা তালাক, আয়াত-৫)
‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে আল্লাহ তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়।’ (সূরা আনফাল, আয়াত-২৯)
এক কথায় তাকওয়ার উপকারিতা হচ্ছে তাকওয়া মানবজাতির ইহকাল ও পরকালের রক্ষাকবজ, যার নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপরোল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা প্রমাণিত।
হে আল্লাহ! দয়া করে আমাদের তাওফিক দিন তাকওয়ার সর্বোচ্চ মর্যাদা, অতুলনীয় তাৎপর্য, অবর্ণনীয় উপকারিতা ও সুফল সত্যিকার অর্থে অনুধাবন ও সার্বক্ষণিকের জন্য স্মরণে রেখে আপনার নিষিদ্ধ কাজ হতে বিরত থাকতে এবং আদিষ্ট কর্মকা- বাস্তবায়ন করতে পারি একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি অর্জন ও পরিণামে জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য। আমিন।
তাকওয়া সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত অনেক আয়াত হতে দুই অংশে গুটিকয়েক আয়াতের আলোচনা আপনাদের খিদমতে পেশ করলাম। বিশ্বাস করি তাকওয়ার তাৎপর্য, গুরুত্ব, উপকারিতার ব্যাপকতা ইত্যাদির ব্যাখ্যা আপনাদের যথাযথ অনুধাবনের জন্য অবশ্যই যথেষ্ট নয়, তবে প্রয়োজনীয় ধারণা দেয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করি।
‘জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (তারা হচ্ছে ওইসব ব্যক্তি) যারা ঈমান আনয়ন করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত-৬২, ৬৩)
ইনশা আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বন করে আমরা হবো আল্লাহর বন্ধু। ফলে আমাদের থাকবে না কোনো ভয়ভীতি, থাকবে না কোনো দুঃখ-কষ্ট পার্থিব জীবনে এমনকি পারলৌকিক জীবনেও। কত বড় সুসংবাদ আমাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে মুত্তাকি হতে পারলে!
‘তোমাদের প্রত্যেকেই সেটা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে, এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাকিদের উদ্ধার করব এবং জালিমদের সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দেবো’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত : ৭১-৭২)।
লক্ষণীয়, দয়ালু আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিগণকে উদ্ধার করবেন জাহান্নাম থেকে বিদ্যুৎ বেগে পুলসিরাত অতিক্রম করিয়ে। চরম পরম সুসংবাদ নয় কি? নিশ্চয়ই চরম পরম সুসংবাদ মুত্তাকিদের জন্য।
‘যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের সব কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের শাস্তি দিয়েছি’ (সূরা আ’রাফ, আয়াত-৯৬)।
আলোচ্য আয়াতে মুত্তাকি হওয়ার পুরস্কার এবং মুত্তাকি না হওয়ার শাস্তির বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে। জনপদের অধিবাসীরা যদি মুত্তাকি হতো তাহলে তাদের জন্য আল্লাহ উন্মুক্ত করে দিতেন মহাবিশ্বের সব কল্যাণ। ফলে তারা হয়ে যেত মহাভাগ্যবান ও মহাসফল উভয় জগতে। তারা তা না হওয়ায় আল্লাহ তাদেরকে দিলেন কঠোর শাস্তি।
‘নিঃসন্দেহে ইলিয়াসও ছিলেন রাসূলদের মধ্যে অন্যতম। স্মরণ করো, যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না?’ (সূরা সাফ্ফাত, আয়াত : ১২৩-১২৪)
আল্লাহর রাসূল ইলিয়াস আ: তাঁর উম্মতগণকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন- তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? এ সরাসরি প্রশ্নটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যেসব নবী রাসূল তাকওয়ার ওপর সঙ্গত কারণে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে তাদের উম্মতগণকে মুত্তাকি হওয়ার উপদেশ প্রদান করেছেন। তাছাড়া আরো প্রমাণ করে তাকওয়ার অপরিসীম উপকারিতা, সুফল, প্রতিদান, তাৎপর্য, গুরুত্ব উভয়কালে। বিশেষ করে জান্নাতে প্রবেশ পরকালে।
‘আমি তোমাদের কাছে এসেছি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নির্দেশসহকারে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার অনুসরণ করো’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত-৫০)।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহর নবী তাঁর উম্মতগণকে সরাসরি আদেশ করছেন আল্লাহকে ভয় করার জন্য, আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে। লক্ষ করুন, আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবীর আদেশ ‘মুত্তাকি হওয়া’ নিজ নিজ মুক্তির জন্য জাহান্নাম থেকে এবং প্রবেশ করার জন্য জান্নাতে যা চিরশান্তি ও আরাম-আয়েশে বসবাসের স্থান।
‘যে ব্যক্তি তার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টির ওপর- সে ব্যক্তি উত্তম, নাকি ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে তার ঘরের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে এমন একটি গর্তের কিনারায়, যার তলায় মাটি নেই? ফলে এটা তাকেসহ (অচিরেই) জাহান্নামের (অতল) আগুনের খাদে গিয়ে পড়বে। আর আল্লাহ কখনো জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না’ (সূরা তাওবা, আয়াত-১০৯)।
আল্লাহর উপরিউক্ত প্রশ্নের জবাবে আমরা মুমিন মুসলিমগণ উত্তর দেবো- ওই ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে সর্বোত্তম যিনি তার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টির ওপর। সম্মানিত পাঠক! আসুন আমরা আল্লাহকে সদা সর্বদা সত্যিকার অর্থে ভয় করি এবং তার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকি একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে আল্লাহ ভীরুদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালোবাসেন’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত : ১৩৩-১৩৪)।
আলোচ্য আয়াতে মুত্তাকিগণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, তারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। সম্মানিত পাঠক! আসুন আমরা সত্যিকার অর্থে মুত্তাকি হই, যাতে করে আমরা আমাদের পরম শত্রু ‘ক্রোধকে’ সংবরণ করতে পারি এবং পরম কল্যাণ ‘ক্ষমা’ করতে পারি মানবগণকে। কারণ ক্রোধ এবং মানবগণকে ক্ষমা করতে না পারা উভয়টাই আমাদের জন্য চরম পরম ক্ষতিকর। অন্যের অপরাধ ক্ষমা করতে পারলেই অর্জন হয় মানসিক শান্তি। তা না হলে প্রবাহিত হতে থাকে মানসিক অশান্তি, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ নেশা, ক্ষতিসাধন বা প্রত্যাঘাত করা।
হে আল্লাহ! দয়া করে আমাদের পরিপূর্ণ মুত্তাকি, মুমিন ও মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ এবং চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার, আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com