সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে বিমানের টিকিটের দাম গত ডিসেম্বর থেকে হুট করে চার-পাঁচগুণ বেড়েছে। ট্রাভেল এজেন্সি ও সংশ্লিষ্টরা এর জন্য করোনার কারণে ফ্লাইট বন্ধের গুজব এবং সিন্ডিকেটকে দুষছেন। তারা মনে করেন, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এমিরেটসের ফ্লাইটে আগামী ১৬ জানুয়ারি দুবাই যেতে ভাড়া গুনতে হবে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। ফার্স্ট ক্লাস কিংবা বিজনেস ক্লাস নয়, এটি ইকোনমিক ক্লাসের একেকটি টিকিটের মূল্য। একই দিনে বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ই্উএস-বাংলা এয়ারলাইনসের দুবাইগামী ফ্লাইটের ভাড়া জনপ্রতি ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরেক প্রতিষ্ঠান ইতিহাদ এয়ারওয়েজে চড়ে আবুধাবি যেতে প্রত্যেকের লাগবে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঢাকা-দুবাই রুটে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনও আসন ফাঁকা নেই। কয়েক মাসে আগেও এই রুটে বিমানের প্রতিটি টিকিটের দাম ছিল ৩৫ হাজার টাকা।
বাজেট এয়ারলাইন ফ্লাই দুবাইয়ে ১৬ জানুয়ারি ঢাকা-দুবাই রুটের ভাড়া ৯৪ হাজার টাকা। আরেক বাজেট এয়ারলাইন এয়ার অ্যারাবিয়ায় ১৬ জানুয়ারি শারজাহ যেতে ভাড়া দিতে হবে ১ লাখ টাকা। আগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে যেখানে ৩০-৪০ হাজার টাকায় যাওয়া যেতো, সেই ভাড়া এখন লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিমান ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা প্রবাসী কর্মীরা। তাদেরই একজন সৌদি আরব প্রবাসী আল আমিন। এ মাসের মধ্যে তাকে কাজে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু টিকিটের দাম বেশি হওয়ায় কীভাবে ফিরবেন কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘বছরে তো লাখ টাকা বেতনও পাই না। এখন এত টাকা দিয়ে টিকিট কাটবো কীভাবে? ধার করা ছাড়া কোনও উপায় দেখছি না। কিন্তু ধার করে গেলে সেটা শোধ করবো নাকি সংসার চালাবো?’
সাউদিয়া-২: মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীদের সবার ক্ষেত্রে একই চিত্র। কর্মস্থলে ফিরতে ধারদেনা করছেন তারা। কিন্তু কীভাবে ঋণ শোধ করবেন তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। হুট করে মধ্যপ্রাচ্য রুটে টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে এয়ারলাইনসগুলো বলছে, সারা বিশ্বে বিমান ভাড়া নির্ধারণ হয় প্রায় একই পদ্ধতিতে। চাহিদা বাড়লে ভাড়া বাড়তে থাকে। একইসঙ্গে ফ্লাইটের কাছাকাছি সময়ে ভাড়া বেড়ে যায়। চাহিদা কমতে থাকলে ভাড়াও কমে আসে।
মধ্যপ্রাচ্য রুটে ভাড়া বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটকে দায়ী করছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)। সংগঠনটি গত ৭ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের দাবি জানায়। আটাব সভাপতি মনছুর আহামেদ কালামের মন্তব্য, ‘সিন্ডিকেট করে অনৈতিকভাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ভাড়া এত বেশি যে প্রবাসী কর্মীদের পক্ষে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অনেকে সুদের ওপর ঋণ নিয়েও অতিরিক্ত মূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। অভিবাসী কর্মীরা দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে। বিমান টিকিটের অনৈতিক উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণ হওয়া জরুরি।’
ফ্লাই দুবাই: ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, গত বছরের ডিসেম্বরে হুট করেই টিকিটের চাহিদা বেড়েছে। কারণ, জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন গুজবে অস্থির হয়ে ওঠেন বেশিরভাগ প্রবাসী। যারা দুই-তিন মাস পর কাজে ফেরার কথা ভেবেছিলেন, তারাও দেশে আটকা পড়ার আশঙ্কায় তড়িঘড়ি টিকিট কিনতে শুরু করেন। টিকিটের এত চাহিদা না থাকলে ভাড়া অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতো না।
ফেব্রুয়ারিতে ছুটি শেষে মার্চে দুবাই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল আব্দুল মজিদের। তিনি ঢাকার পল্টন এলাকায় জানুয়ারিতেই কর্মস্থলে ফিরতে টিকিট খুঁজছেন। কিন্তু ভাড়া বেশি হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না কী করবেন। কেন এক মাস আগে ফিরে যাবেন জানতে চাইলে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘শুনেছি জানুয়ারিতে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। একবার বন্ধ হলে কবে খুলবে তার তো ঠিক নাই। আমার সঙ্গে দেশে আসা অনেকেই কাজে ফিরে গেছে। অথচ আমি এখনও যেতে পারি নাই।’
ইউএস বাংলা: ভাড়া কয়েকগুণ বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে আটাবের সাবেক সভাপতি এসএন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুবের মন্তব্য, ‘সৌদি আরবে ওমরাহ হজের জন্য যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। আবার সৌদি আরব ও দুবাইয়ে জনশক্তি রফতানিও বেড়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির আগে যত সংখ্যক ফ্লাইট পরিচালিত হতো, এখন তার চেয়ে প্রায় ৬০ ভাগ কমে গেছে। চাহিদার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা না থাকায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এছাড়া কোনও কোনও এয়ারলাইনের অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গুটিকয়েক এজেন্সি সিন্ডিকেট করে যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট ছাড়াই ফ্লাইটের আসন ব্লক করে রাখছে। এভাবে কৃত্রিম একটি সংকট তৈরি হয়েছে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন মেনে নিচ্ছেন, অত্যধিক ভাড়া দিয়ে প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরা সম্ভব নয়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিমান ভাড়া নাগালের মধ্যে নিয়ে আসাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। সিভিল এভিয়েশন সব এয়ারলাইনকে নিয়ে বসেছে, যাতে ভাড়ার একটা সীমা থাকে। ভাড়া যেন অসহনীয় পর্যায়ে না যায় সেজন্য আমরা কাজ করছি। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করা হচ্ছে।’
ইতিহাদ: ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন আটাবের সাবেক সভাপতি এসএন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব। একইসঙ্গে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট ছাড়া আসন ধরে রাখার সুযোগ বন্ধ করার পক্ষে মত দেন তিনি। তার কথায়, ‘সংকট নিরসনে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব নিতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনা করে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন।’ বিমান ভাড়ার বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাড়া আন্তর্জাতিক নিয়মে নির্ধারিত হয়। আমরা বিমান সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছি। আশা করি তারা আমাদের অনুরোধে সাড়া দেবে।’ প্রতিমন্ত্রীর কথায়, ‘প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অবগত আছেন। আমরা জানি, ভাড়া বৃদ্ধির কারণে প্রবাসী কর্মীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। ইতোমধ্যে আলাপ-আলোচনা করেছি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস থেকে কীভাবে ভর্তুকি দিয়ে হলেও বিশেষ ফ্লাইট চালানো যায় সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে কম ভাড়ায় আমাদের প্রবাসী কর্মীরা যাতায়াত করতে পারেন।’-বাংলাট্রিবিউন