বিশ্বের প্রথম মুক্ত-সোর্স ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন। একটি বিটকয়েনের মূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৬ লাখ টাকা। প্রতিদিন এর মূল্য ওঠানামা করে। বিটকয়েন লেনদেনে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার প্রয়োজন হয় না। পিয়ার টু পিয়ার মানে গ্রাহকের সঙ্গে গ্রাহকের সরাসরি যোগাযোগে অনলাইনে লেনদেন হয় বিটকয়েন। ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতা নামে কোনো এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিটকয়েনের প্রচলন শুরু হয়। যদিও এই নামে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি এখন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের মোট ৬৯টি দেশে সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে চলছে এই মুদ্রার লেনদেন। প্রতিবেশী ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছে এই মুদ্রার লেনদেনকে। তবে বাংলাদেশ ২০১৪ সালে অবৈধ ঘোষণা করে বিটকয়েন লেনদেনকে। বিটকয়েন নিষিদ্ধ, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে আলজেরিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, মরক্কো, নেপাল ও মেসিডোনিয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশের আইন অনুযায়ী বিটকয়েন বা অন্য কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন বা সংরক্ষণ করা বেআইনি। যেহেতু ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে না, সেজন্য এর বিপরীতে আর্থিক দাবির কোনো স্বীকৃতিও থাকে না। ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের মাধ্যমে অর্থপাচার এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। পাশাপাশি এ ধরনের লেনদেনের মাধ্যমে আর্থিক এবং আইনগত ঝুঁকিও রয়েছে। এসব সতর্কতার কথা জানিয়ে বিটকয়েনে লেনদেনের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ২৯ জুলাই এমন আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রার মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন অবৈধ। তাই আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি এড়াতে বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন বা সহায়তা প্রদান ও এর প্রচার থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স¤প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায় যে, দেশে অনলাইনভিত্তিক ভার্চুয়াল মুদ্রার (বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, রিপল, লিটকয়) বিনিময় বা লেনদেন হচ্ছে। এসব ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত বৈধ মুদ্রা নয়। এসব মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয়, তাই এর বিপরীতে কোনো আর্থিক দাবির স্বীকৃতিও থাকে না। ভার্চুয়াল মুদ্রায় এসব লেনদেন অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। একইসঙ্গে বৈধ কোনো সংস্থার স্বীকৃত না হওয়ায় গ্রাহকরা ভার্চুয়াল মুদ্রার সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকিসহ নানা ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন। এমতাবস্থায় আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি এড়াতে বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিটকয়েন লেনদেনে এ পর্যন্ত যারা ধরা পড়লেন: গত বছরের ১৯ জুন রাজধানীর দারুস সালাম এলাকা থেকে অবৈধ বিটকয়েন ক্রয়-বিক্রয় চক্রের অন্যতম হোতা হামিম প্রিন্স খানসহ চার সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-৪। হামিম ২০১৩ সালে ফরিদপুরের একটি কলেজ থেকে ইংরেজিতে বিএ (সম্মান) পাস করেন। এরপর ২০১৩ সালে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে কম্পিউটারের ওপর দক্ষতা লাভ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিলেন। পরে তিনি ক্রিপ্টোকারেন্সির ওপর দক্ষতা লাভ করে প্রায় ৫০ জনের বেশি মানুষকে বিটকয়েন লেনদেনের প্রশিক্ষণ দেন। বিটকয়েন ছাড়াও তিনি লিটকয়েন, ডগকয়েন, ইথারিয়াম, ব্রাস্ট ও ন্যানো লেনদেনের সঙ্গেও জড়িত।
হামিম প্রিন্স খান মূলত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডাসহ উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ কার্যক্রম চালিয়ে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে অন্যের ক্রেডিট কার্ড হ্যাক করে বিটকয়েন কিনে এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। ভার্চুয়াল জগতে তার ১৫-১৬টি ওয়ালেট রয়েছে। র্যাব জানায়, প্রতি মাসে তারা দেড় কোটি টাকা বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেন করতেন। তারা ভার্চুয়াল জগতে অবৈধ ডার্ক পর্নোসাইট থেকে পর্নোগ্রাফি ক্রয় করেন। এরপর পর্নোগ্রাফিগুলো বেশি অর্থের বিনিময়ে দেশের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ছড়িয়ে দিতেন।
বিশ্বের প্রথম ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েন: গত বছরের ১২ জানুয়ারি রায়হান হোসেন (২৯) নামের এক প্রতারককে গ্রেফতার করে র্যাব। তখন বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, বিটকয়েন চক্রকে শনাক্ত করতে গিয়ে রায়হানের নাম উঠে আসে। পরে তাকে গাজীপুরের সফিপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব-১। তখন তার একটি অ্যাকাউন্টে ৫৪ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এছাড়া ২৭১টি অ্যাকাউন্টে মাত্র এক মাসে ৩৫ হাজার ডলার লেনদেন করেন তিনি। পাকিস্তান, রাশিয়া ও নাইজেরিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলে বিটকয়েন লেনদেন করতেন রায়হান। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস রায়হান ২০০৬ সালে ব্যক্তিগত আগ্রহে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ করেন। ২০২০ সালের জুন থেকে পাকিস্তানেরনাগরিক সাইদের (২২) সহায়তায় প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া শুরু করেন। তিনি বিদেশি পাচারকারী ও হ্যাকারের সহায়তায় ক্রেডিট কার্ড হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েন কিনতেন। বিটকয়েন বিক্রি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে রায়হান অল্প দিনেই কোটিপতি বনে যান। তিনি এক কোটি সাত লাখ টাকা দামের গাড়িতে চলাফেরা করতেন। থাকতেন দামি ফ্ল্যাটে। গত বছরের ২ মে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার বেসিক বিজ মার্কেটিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিটকয়েন লেনদেনের অন্যতম হোতা ইসমাইল হোসেন সুমন ওরফে কয়েন সুমনসহ (৩২) ১২ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। তখন র্যাবের তরফ থেকে বলা হয়, ছোট্ট একটি দোকানে বাচ্চাদের কাপড় ও খেলনার ব্যবসা করছিলেন সুমন। সেখানে কম্পিউটার বসিয়ে আস্তে আস্তে গড়ে তোলেন বেসিক বিজ মার্কেটিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান। আউটসোর্সিং মার্কেটিংয়ের ওই প্রতিষ্ঠানের আড়ালেই চলছিল তার বিটকয়েন ব্যবসা। তিনি এক পর্যায়ে বানিয়ে ফেলেন একাধিক ভার্চুয়াল ওয়ালেট। যেখানে মজুদ করেন বিটকয়েন লেনদেনে অর্জিত লক্ষাধিক ডলার। শুধু তাই নয়, বিটকয়েন লেনদেনের মাধ্যমে তিনি গড়ে তোলেন ফ্ল্যাট, প্লট, সুপার শপসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
শতাধিক প্রভাবশালী বিটকয়েন লেনদেনে, নজরদারিতে গোয়েন্দারা: গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বিটকয়েনে লোকসানের কোনো রেকর্ড থাকে না। এটি নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা চলছে। জি-২০ এর সম্মেলনেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই মুদ্রা ব্যবহার করে বিদেশে যে অর্থপাচার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই কালো টাকা। দেশের অন্তত শতাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এর সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে। এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশ যেহেতু এখনো বিটকয়েনের স্বীকৃতি দেয়নি তাই আমরা এর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে কাজ করে চলেছে। গত কয়েক বছরে র্যাব অবৈধ বিটকয়েন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন বাংলাদেশে বিটকয়েন ব্যবসার অন্যতম হোতা। দেশে কিংবা দেশে বসে বিদেশি চক্রের সঙ্গে কেউ বিটকয়েন লেনদেনের সঙ্গে জড়িত কিংবা ব্যবসা পরিচালনা করছে কি না তা নজরদারি করছেন র্যাবের গোয়েন্দারা। সাইবার ওয়ার্ল্ডেও র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। বিটকয়েন দিয়ে অবৈধ ব্যবসা করে কেউ পার পাবে না। বিটকয়েনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এখনো আমরা দেশে বিটকয়েন লেনদেনের অনুমতি দেইনি। তবে আগামীতে অনুমতি দেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।
বিটকয়েন চালু হলে অর্থপাচার বেড়ে যাবে: এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, বিটকয়েনের বৈধতা না দেওয়াটাই ভালো। এটির উচ্চমাত্রায় ঝুঁকি আছে। বিটকয়েন কে সৃষ্টি করেছে তা কেউ জানে না, এটির কোনো মালিকানা নেই কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো সাপোর্ট নেই। এ ধরনের জিনিস কিনে মানুষ ঠকবে, তাই সরকারের অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এটি লেনদেনের বৈধতা দিলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য হুমকি স্বরূপ হবে। এছাড়া বিটকয়েন চালু হলে টাকা পাচার বেড়ে যাবে। অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখার আদর্শ হচ্ছে বিটকয়েন কিংবা এই ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি।-জাগোনিউজ২৪.কম