সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান খুনের মামলায় আদালতের দেওয়া রায় কার্যকরের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবার। বিশেষ করে কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ ও টেকনাফের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিকেই বেশি মনোযোগ থাকবে।
গতকাল শনিবার সকালে উত্তরার বাসায় রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) প্রতিনিধিদল পরিবারের সঙ্গে দেখা করার পর সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন মেজর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাওয়ার ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ও রাওয়ার সেক্রেটারি জেনারেল লে. কর্নেল (অব.) কামরুল ইসলাম। সিনহা হত্যা মামলার রায়ের বিষয়ে তাঁরা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সিনহার বাসায় ছিলেন।
শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘আদালতের প্রতি আমাদের সম্মান আছে। আদালতের রায়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। প্রথম যে দুজন আছেন, যাঁদের মৃত্যুদ- হয়েছে, সেই রায় যেন কার্যকর হয়। এখন আমরা ফোকাস হারাতে চাই না। এতে রায় কার্যকরে বাধা আসতে পারে। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য রায় কার্যকরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।’
মেজর সিনহা দেশের একজন বীর সন্তান উল্লেখ করে শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘মেজর সিনহা শুধু আমার ভাই না, সে এখন নেশনস ব্রাদার। তার মৃত্যুর পর চরিত্রহরণের চেষ্টা করা হয়েছিল। ইয়াবা কারবারি বানানোর চেষ্টা হয়েছিল। সিনহাকে হত্যা করার পর তারা বুঝতে পেরেছিল, বড় ভুল করেছে। তারা ভেবেছিল চরিত্রহরণ করে, খারাপ লোক বা ইয়াবা ব্যবসায়ী বানাতে পারলে বেঁচে যাবে। এ কারণেই সিনহার বিরুদ্ধে তারা অপপ্রচার করেছিল। কিন্তু এসব ধোপে টেকেনি।’
কামরুল ইসলাম বলেন, ‘যে রায় হয়েছে, সেটি যেন শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়, সেটি এখন চাওয়া। যাদের সাজা কম হয়েছে, সেটি বৃদ্ধি করা এবং যারা বাদ পড়েছে, তাদের সাজার আওতায় আনতে আমরা আপিল করব। আমরা দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থাশীল।’ এদিকে গত ৩১ জানুয়ারি মেজর সিনহা হত্যায় ২ জনের মৃত্যুদ- ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত। কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এ রায় দেন। আদেশে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদ-, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, মারিশবুনিয়া গ্রামের তিন ব্যক্তি নেজাম উদ্দিন, নুরুল আমিন ও মো. আইয়াজকে যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদ- দেওয়া হয়। বেকসুর খালাস পান বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের এএসআই মো. লিটন মিয়া, টেকনাফ থানার কনস্টেবল ছাফানুল করিম, মো. কামাল হোসাইন আজাদ, মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের তিন সদস্য এসআই মো. শাহজাহান আলী, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। তাঁর সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তাঁর ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।
সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। তিনটি মামলার দুটি মাদক রাখার অভিযোগে এবং একটি পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে। এ ঘটনায় হত্যা মামলাটি করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। ওই বছরের ৫ আগস্ট আদালতে করা মামলায় তিনি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের ৯ সদস্যকে আসামি করেন।
চারটি মামলারই তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। পরে র্যাব এ ঘটনায় প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ১২ জন পুলিশ সদস্য ও ৩ জন গ্রামবাসী। পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো সত্যতা না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে র্যাব। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ওসি প্রদীপ কুমার দাশের পূর্বপরিকল্পনায় আসামিরা মেজর (অব.) সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেন।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে আসামি করে কক্সবাজার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাব। গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ২৭ জুন প্রদীপসহ ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়েছিল।