রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ অপরাহ্ন

আসছে নিম্নচাপ বন্যা তাপপ্রবাহ

খবরপত্র ডেস্ক
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২

চলতি মাসে দেশের কিছু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া এ মাসেই একটি নিম্নচাপ এবং তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। গত বৃহস্পতিবার জুন মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে এ কথা বলা হয়। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জুন মাসে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ মাসের প্রথম দশকে সারাদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষাকাল) বিস্তার লাভ করতে পারে। এছাড়া এ মাসে বঙ্গোপসাগরে ১-২টি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমী নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। চলতি মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে ১-২ দিন বিজরী চমকানোসহ মাঝারি ধরনের বজ্রঝড় হতে পারে। এছাড়াও সারাদেশে ৪-৬ দিন বিজলী চমকানোসহ হালকা বজ্রঝড় হতে পারে। জুন মাসে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সে.) থেকে মাঝারি (৩৮-৪০ ডিগ্রি) তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে বলেও জানানো হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে। পূর্বাভাসে নদ-নদীর অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, জুন মাসে ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
প্রায় প্রতি বছরই বন্যাসহ বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয় এদেশের মানুষকে। কিন্তু কেন? এ্ই দায় কার? এসম্পর্কে দৈনিক প্রথমআলোতে ‘বন্যার দায় কার?’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘প্রতিচিন্তার্’ সহকারী সম্পাদক খলিলউল্লাহ লিখেছেন,‘ আমরা ভেবে থাকি, বন্যা তো প্রাকৃতিকভাবেই আসে। এর জন্য আবার কে দায়ী হবে? কিন্তু সা¤প্রতিক কালের বন্যার পেছনে মানুষের দায় আছে। মানুষের কার্যকলাপের কারণে সংঘটিত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্বাভাবিক মাত্রার বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নত রাষ্ট্রগুলো দায় এড়াতে পারে না।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ৩০ বছরে এশিয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল এমনিতেই এই মহাদেশের সবচেয়ে পানিবহুল আর পৃথিবীর অন্যতম পানিবহুল এলাকা। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ১ হাজার মিলিমিটার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ২০১২ সালে করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভারী বর্ষণ বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ উপকূলীয় বা অভ্যন্তরীণ বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে। ১৯৫০-২০১৭ সাল পর্যন্ত উপাত্তে দেখা যায়, বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের ২২ লাখ মানুষ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে শুধু ১৯৫৯ সালের বন্যায় চীনে ২০ লাখ মানুষ মারা যায়।
বৈশ্বিক আবহাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব সবারই জানা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভারী বর্ষণ ঘটে চলেছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে বন্যার সৃষ্টি হয়। বার্ষিক বৃষ্টিদিনের সংখ্যা কমে যায়, কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের ঘটনা বেড়ে যায়। দেখা যায়, অনেক দিন ধরে বৃষ্টি না হয় না, কিন্তু হঠাৎ এক দিনে বা এক ঘণ্টায় অতিমাত্রায় বৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শ্রাবণ মাসে এখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির বদলে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। এটা গত কয়েক বছরের ধরন। কিন্তু সাধারণত শ্রাবণ মাসে মুষলধারে বৃষ্টি হয় না। খনার বচনে ‘শ্রাবণধারা’ উল্লেখ আছে। মানে একটানা বৃষ্টি হবে কিন্তু মুষলধারে নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, টানা কয়েক দিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে তারপর আবার প্রকট উত্তাপ শুরু হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, নদী অপদখলে চলে যাওয়া ইত্যাদি যোগ হয়ে অতিবৃষ্টির পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়। ফলে তা বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফসল, সম্পদ, ঘরবাড়ির সঙ্গে মানুষকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা সংগঠনের জলবায়ু বিশেষজ্ঞ দেবী কিরোনো সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এশিয়াব্যাপী মানুষের জীবন শুধু যে বন্যার প্রাথমিক ধাক্কায় বিপদের মুখে পড়ে তা নয়। পানিবাহিত রোগের জীবাণু বিকশিত হওয়ার জন্য উচ্চ তাপমাত্রা আদর্শ পরিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু বন্যা নয়, তাপমাত্রাও বৃদ্ধি করছে। ফলে বন্যায় সব ভাসিয়েই তা ক্ষান্ত হচ্ছে না, তাপমাত্রা বাড়িয়ে বন্যাপরবর্তী পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়াতেও বড় ভূমিকা রাখছে।
তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ভারতীয় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে তারতম্য দেখা দিচ্ছে। বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। মৌসুমি বায়ুর আগমন বিলম্বিত হওয়া ছাড়াও অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তা অনিয়ন্ত্রিত বন্যায় রূপ নিচ্ছে। রবার্ট কয়েনরাড তাঁর ন্যাচারাল ডিজাস্টার অ্যান্ড হাউ উই কোপ গ্রন্থে দাবি করেছেন যে ২০ শতকের বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বন্যার মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে বন্যার পৌনঃপুনিকতা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের ২০০৯ সালের জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাভাবিক বছরে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ডুবে যায়। প্রতি চার-পাঁচ বছরে একটি প্রবল বন্যা আসে, যা দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবিয়ে দেয়।’
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু অতিবৃষ্টির মাধ্যমেই বন্যার সৃষ্টি করছে, এমন নয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দ্রুত ভোগান্তিতে পড়তে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে বাংলাদেশ। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে মানুষ প্রায় প্রতিবছর বানভাসি হচ্ছে। সায়েন্টিফিক আমেরিকান সাময়িকীতে রবার্ট গ্লেনন বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে লিখেছেন যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তিন ফুট বাড়লে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে এবং তিন কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। তবে বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ দাবি করেন যে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পাঁচ-ছয় ফুট বাড়তে পারে এবং তাতে সম্ভবত পাঁচ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।
এ ছাড়া হিমালয়ের হিমবাহ ও স্নোপ্যাক গলে গিয়ে নদীগুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে, যা বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। ভারতের পানি নীতিও বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে ব্যাপক আকারে নদীর গতিপথ বদলে সেচকাজে পানি ব্যবহার করছে ভারত। কিন্তু বন্যা শুরু হলে বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বন্যার তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষও বন্যাকবলিত হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তাই দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য বাজেট সহায়তা হিসেবে তারা দুই হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশকে ঋণ দিতে চায় (প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট ২০১৭)। তবে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ যতটা না প্রাকৃতিক কারণে ঘটছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। বাংলাদেশের জনগণ এসব দুর্যোগের মধ্যে দিনরাত পার করছে। কিন্তু এর জন্য তারা আসলে কতটা দায়ী? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যতটুকু কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন দরকার, তার মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ নির্গমন করে বাংলাদেশ। বেশির ভাগ নির্গমনের জন্য দায়ী উন্নত রাষ্ট্রগুলো, যারা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাই ঋণ নয়, বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে মনোযোগী হয়ে জোর তৎপরতা চালাতে হবে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জনে ধনী রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের পর এটা আর শুধু তাদের নৈতিক দায়ই নয়, আইনগত বাধ্যবাধকতাও।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com