যুব উন্নয়ন সংসদ, ঢাকার আয়োজিত ‘মাদকের ভয়াবহতা ও মুক্তির উপায়’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে বক্তারা বলেছেন, মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে দরকার সামাজিক আন্দোলন এবং ধর্মীয় শিক্ষা। এছাড়া দরকার মাদকের উৎস নষ্ট করার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে মাদক আসা বন্ধ করা। আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস উপলক্ষে গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এই সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুর রব। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী।
সংগঠনের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ আল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিম্পোজিয়ামে অন্যদের মধ্যে বিএসএমএমইউর শিক্ষক, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আতিয়ার রহমান, পরিবেশবিদ ড. হেলাল উদ্দিন, সুপ্রীম কোর্টোর আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম ইউসুফ আলী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ড. মুহাম্মাদ আবু ইউছুফ খান। সিম্পোজিয়াম সঞ্চালনা করেন যুব উন্নয়ন সংসদের উদ্যোক্তা কামাল হোসেন।
অধ্যাপক ড. আব্দুর রব বলেন, মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য সর্বস্তরে মাদক পরিহার করতে হবে, মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণ শুধু আইনি ও সামাজিক বিষয় নয়। বরং এটি ঈমান ও আমলের সাথে স¤পর্কিত অতীব জরুরি বিষয়। মাদকমুক্ত সমাজই একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ উপহার দিতে পারে। মাদক রোধে আমাদের সবাইকে অধিক সচেতন হতে হবে। মাদকের কারণে বাংলাদেশ বড় রকমের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আসুন দল মত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মাদককে সকলে না বলি এবং আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে মাদক নির্মূলে ভূমিকা রাখি। মাদকমুক্ত কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বস্তরে মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি।
তিনি বলেন, মাদক মানুষকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। মাদকসেবীরা নিজেরাও মরে সঙ্গে পরিবার ও সমাজকেও মারে। বাংলাদেশে ৭০ লাখ মাদকসেবী রয়েছে এবং ১ লাখ ৬০ হাজার মাদক কারবারি রয়েছে। একজন মাদকসেবী দিনে প্রায় ১৫৬ টাকার মাদক সেবন করে। সীমান্তে অসংখ্য মাদক কারখানা রয়েছে। আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ পরিকল্পিতভাবে মাদক দিয়ে আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যাতে তরুণ সমাজ ভালো কিছু না করতে পারে। তিনি মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সুসমন্বিতভাবে কাজ করলে মুক্তি পেতে পারি। ৬৪ জেলায়, বিভাগে সেমিনার সিম্পোজিয়াম করার আহ্বান জানান তিনি। সেইসাথে দেশের ঈমামদের মাধ্যমে জনগণকে সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন ড. রব। রুহুল আমিন গাজী বলেন, কারাগারে দেখলাম বন্দীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ মাদক ব্যবসায়ী। সেখানে মাদক মামলার আসামীরা যায় আর আসে। কারাগারে মাদক পান ও কারবার অত্যন্ত সহজলভ্য। মাদক কারবার অত্যন্ত ভালো চলে। শুধু নি¤œস্তরের মানুষ নয়, উচ্চস্তরের অনেকে মাদক পান করে প্রগতিবাদী হওয়ার জন্য। মাদক মানুষের নৈতিকতা নষ্ট করে দেয়। মস্তিষ্ক পঙ্গু করে দেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তিনদিকে ভারত আর একদিকে বঙ্গোপোসাগর। পার্শ্ববর্তীদেশে আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি হাজার হাজার মাদক কারখানা। এসব কারখানা থেকে আমাদের দেশে সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মাদকের মূল গডফাদার থেকে শুরু করে এর বিক্রেতা, পাচারকারী, সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারী সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও জনসচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে।
ড. মুহাম্মাদ আবু ইউছুফ খান তার প্রবন্ধে পারিবারিক সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, যুব সমাজকে মাদকমুক্ত করতে পারিবারিক,সামাজিক এবং রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। এর মধ্যে পরিবারের কেউ যাতে মাদকদ্রব্যের সাথে জড়িয়ে পড়তে না পারে সে ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে; পারিবারিক বন্ধন শক্তিশালী করতে হবে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে সন্তানদের সময় দিতে হবে, তাদের নিয়মিত খোঁজ নিতে হবে,তাদের বই পড়া, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে; সন্তানের সামনে স্বামী-স্ত্রী বিরোধ করা যাবে না, নিজেরা সংযত জীবনযাপন এবং সন্তানদের ছোটবেলা থেকে সংযত জীবন যাপনের মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থ করতে হবে ; পরিবারে কোন মাদকাসক্ত ব্যক্তি থাকলে তাকে অপরাধী না ভেবে এবং তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ না করে বরং একজন অসুস্থ ব্যক্তি হিসেবে সাহায্য ও ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে; সন্তানের সামনে ধূমপান বা নেশা না করা, ধূমপান বা নেশার উপকরণের ব্যাপারে সন্তানের কোন স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসাকে উপযুক্ত ব্যাখ্যা এবং জবাবের মাধ্যমে নিবৃত্ত করা এবং এর কুফল সম্পর্কে তাকে বুঝাতে হবে; সন্তানের চালচলন, কথাবার্তা, অন্যের সাথে মেলামেশা, ঘরের বাইরে যাওয়া এবং সময়মত ফিরে আসা, খাওয়া দাওয়া, মেজাজ, আচরণ, অভ্যাস ইত্যাদি সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে; সন্তানকে অভিশাসন বা অতি আদর করা এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সন্তানের হাতে টাকা দেয়া উচিত নয়; কোন কাজে সন্তানের অসফলতায় শান্তি নয়, সান্ত¡না ও পরামর্শের হাত বাড়িয়ে নিতে হবে; সন্তান একরোখা, স্বেচ্ছাচারী, জেদী, কলহপ্রবণ, মারমুখী কিংবা দূর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলে শৈশবেই তার মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের চেষ্টা করা এবং তাকে আত্মবিশ্বাসী, সচেতন ও সুস্থ শিশু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বড় হলে সহজেই অন্যের প্রভাবে মাদকাসক্ত হতে পারে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে মাদক জাতীয় জিনিসের অবাধ লাইসেন্স বন্ধ করা;মাদকতার বিরুদ্ধে আইন শৃংখলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা; আন্তর্জাতিকভাবে মাদক চোরাচালানির সকল উৎসমূখ বন্ধ করা;মাদকতা বিপনন ও গ্রহণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করে বাস্তবায়ন করা এবং ২০২০ সালে প্রণীত ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন’ যথাযথভাবে কার্যকর করা প্রয়োজন।
ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, মাদক এমন এক জিনিস যা পান করলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এমনকি মাদকের কারণে পুত্র পিতাকেও হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। বাংলাদেশে মাদক নির্মূলের পরিবর্তে মাদককে উৎসাহিত করা হয়। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি বেকারত্ব, হতাশামুক্ত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার বাড়ানোর ওপর জোর দেন। ডা. আতিয়ার বলেন, মাদক সেবনের কারণে মুখমন্ডল ফুলে যাওয়া, মুখ চোখ নাক লাল হওয়া, ক্ষুধামন্দা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, বুক ও ফুসফুস নষ্ট হওয়া, চর্ম রোগ বৃদ্ধি পাওয়া, ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, আলসার হওয়া এবং যৌন শক্তি কমে যায়। যে নেশার দ্রব্য গ্রহন করার ফলে ব্যক্তির শারিরীক ও মানসিক একটা পরিবর্তন ঘটে এবং ব্যক্তির ঐ দ্রব্যের প্রতি ধীরে ধীরে বেশিমাত্রায় নেশা হওয়া, যা তার সামাজিক ও দৈনন্দিন কার্যাবলিতে প্রভাব রাখে এটাই নেশাদ্রব্য বা মাদকদ্রব্য।
শহীদুল ইসলাম বলেন, ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে এককোটি মানুষ যদি মাদকাসক্ত হয় তাহলে এর ভয়াবহতা বোঝাই যায়। এর কারণে সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। সন্তানের মাদকাসক্তির জন্য মা-বাবার ঘুম হারাম হচ্ছে। খুন ধর্ষণের পেছনেও মাদক ভূমিকা পালন করে। কেবল মাত্র ইসলামী অনুশাসন প্রতিপালনই মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করতে পারে। সভাপতির বক্তব্যে ইঞ্জি. শেখ আল আমিন বলেন, বর্তমান বিশ্ব যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন তার মধ্যে মাদকাসক্তি অন্যতম। বিশ্বজুড়ে আজ মাদকাসক্তি একটি জটিল সামাজিক ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের সমাজে এই দূরারোগ্য ব্যাধির তীব্রতা আরও বেশি প্রবল। এর শিকার হয়ে দেশের যুবসমাজ তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। তাই এ ব্যাপারে মা-বাবা ভাই-বোন সহ পরিবারের সদস্যদের সচেতন হওয়া জরুরি।