পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে জয়-পরাজয়ও রয়েছে। প্রত্যেকের বিজয় উৎসব পালনে রয়েছে ভিন্নতা। মুসলমানদের ইতিহাসেও রয়েছে বিজয়ের অনেক ইতিহাস। কিন্ত তাদের বিজয় নানা দিক থেকে অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী থেকে আলাদা। চিন্তা, চেতনা, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মনীতি এবং কর্মপন্থার দিক থেকে এ বিজয় ছিল ভারসাম্য নীতির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর ইতিহাসে যদি আমরা চোখ বুলাই তাহলে বিভিন্ন জাতির বিজয় ও বিজয় পরবর্তী নানা ধরনের আচরণ আমরা দেখতে পাবো। আল-কুরআনের বর্ণনা ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ থেকে আমরা মুসলমান ও অন্যান্য জাতির বিজয় ও বিজয় পরবর্তী আচরণের ভিন্নতা দেখতে পাই।
অন্যান্য জাতির বিজয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রানী বলল, কোনো বাদশাহ যখন কোনো দেশে ঢুকে পড়ে তখন সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং সেখানকার সম্মানিত লোকদের বা মর্যাদাশীলদের লাঞ্ছিত করে। এ রকম কাজ করাই তাদের রীতি।’ (সূরা নামল-৩৪) অর্থাৎ অন্যান্য জাতির বিজয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বা বাস্তব চিত্র রানীর (হজরত সোলাইমান আ: যে রানীকে পত্র দিয়েছিলেন সম্ভবত রানী বিলকিস হবে) মুখ দিয়ে বের করিয়েছেন। সত্যিকারার্থে রাজ-রাজড়া দেশ জয় ও বিজেতা কর্তৃক অন্য জাতির ওপর হস্তক্ষেপ বা কর্তৃত্ব কখনো সংশোধন ও মঙ্গলাকাঙ্খার উদ্দেশ্যে হয় না। এর উদ্দেশ্য হয়, অন্য জাতিকে আল্লাহ যে রিজিক এবং উপায়-উপকরণ দিয়েছেন তা থেকে নিজেরা লাভবান হওয়া ও সংশ্লিষ্ট জাতিকে এতটা দাবিয়ে দেয়া, যার ফলে সে আর কখনো মাথা উঁচু করে নিজের অংশটুকু চাইতে না পারে। এ উদ্দেশ্যে সে তার সমৃদ্ধি, শক্তি ও মর্যাদার যাবতীয় উপায়-উপকরণ খতম করে দেয়। তারা যেসব লোকের মধ্যে আত্ম-মর্যাদাবোধের লেশমাত্র সঞ্জীবিত থাকে তাদেরকে দলিত মথিত করে। তারা লোকদের মধ্যে তোষামোদ-প্রিয়তা পরস্পরের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি, একে অন্যের গোয়েন্দাগিরি করা, বিজয়ী শক্তির অন্ধ অনুকরণ করা, নিজের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে হেয় মনে করা, হানাদারদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে গোলামি দান করা এবং এমনিতর অন্যান্য নিচ ও ঘৃণিত গুণাবলি সৃষ্টি করে দেয়। তার সাথে তাদেরকে এমন স্বভাবের অধিকারী করে তোলে, যার ফলে তারা নিজেদের পবিত্রতম জিনিসও বিক্রি করে দিতে ইতস্তত করে না এবং পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যাবতীয় ঘৃণিত কাজ করে দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়।
পক্ষান্তরে আল-কুরআন অন্য এক জাতির বিজয়ের ভিন্নরূপ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এরা এমন সব লোক যাদেরকে আমি যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দেবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজ নিষেধ করবে। আর সমস্ত পরিণাম আল্লাহর হাতে।’ (সূরা হজ-৪১) অর্থাৎ মুসলমানদের গুণাবলি হচ্ছে এই যে, যদি দুনিয়ায় তাদেরকে রাষ্ট্র ও শাসনক্ষমতা দান করা হয় তাহলে তারা ব্যক্তিগত জীবনে ফাসেকি, দুষ্কৃতি, অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতার শিকার হওয়ার পরিবর্তে সালাত কায়েম করবে। তাদের ধন-সম্পদ বিলাসিতা ও প্রবৃত্তি পূজার পরিবর্তে জাকাত দানে ব্যয়িত হবে। তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র সৎকাজকে দাবিয়ে দেয়ার পরিবর্তে তাকে বিকশিত ও সম্প্রসারিত করার দায়িত্ব সম্পন্ন করবে। তাদের শক্তি অসৎকাজকে ছড়ানোর পরিবর্তে দমন করার কাজে ব্যবহৃত হবে।
আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিজয় ইতিহাস থেকেও বিজয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বিজয় পরবর্তী বিজয়ীদের আচার-আচরণের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেখতে পাই। মক্কা বিজিত হলো। প্রিয় জন্মভূমি মক্কার হারাম শরিফে দাঁড়িয়ে আছেন মজলুম মানবতার মজলুম নবী মুহাম্মাদ সা:। যেখান থেকে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন, যেখানে তাঁকে গালি দেয়া হয়েছিল, যেখানে তাঁর ওপর নাপাক বস্তু নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যেখানে তাঁকে বহুবার নিন্দনীয় হত্যার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, যেখানে তাঁর ওপর প্রস্তর নিক্ষেপ করা হতো, চলার পথে কাঁটা বিছানো হতো, যারা তাঁর বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করেছিল, তাঁর আত্মীয়ের বক্ষ বিদীর্ণ করে হৃৎপি- ও নাড়িভুঁড়ি কেটে টুকরা টুকরা করেছিল, যেখানে অসহায় দরিদ্র মুসলমানদের তপ্ত বালিকায় শুইয়ে দিয়ে পাথরচাপা দিতো, জলন্ত কয়লা দিয়ে তাদের অঙ্গে দাগ দিতো, বর্শাঘাতে তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করত। এসব অপরাধীর দল সে দিন পরাজিত ও পর্যুদস্ত অবস্থায় সামনে দাঁড়িয়েছিল। পেছনে ১০ হাজার রক্তপিপাসু তরবারি কেবল মুহাম্মাদ সা:-এর একটি ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ছিল। অকস্মাৎ তিনি মুখ খুললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন : ‘হে কুরাইশগণ! বলো, আজ তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিত।’ জবাব এলো ‘মুহাম্মাদ! তুমি আমাদের শরিফ ভাই ও শরিফ ভাতিজা।’ রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আজ আমি তোমাদেরকে তাই বলছি, যা হজরত ইউসুফ আ: তাঁর জালিম ভাইদের বলেছিল।’ অর্থাৎ ‘আজকের দিনে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা সবাই আজ মুক্ত।’
আবু সুফিয়ান মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত যার অপরাধের কোনো সীমা ছিল না। বদর, উহুদ ও খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিপরীতে কাফের সেনাদলের সর্দার ছিল। যে ব্যক্তি হাজার হাজার মুসলমানের জীবন নাশের কারণ। যে কয়েকবারই রাসূলুল্লাহ সা:-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। যে ব্যক্তি পদে পদে ইসলামের ঘোরতর শত্রু প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু মক্কা বিজয়ের আগে যখন হজরত আব্বাস রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামনে তাকে হাজির করলেন, তখন তাঁর প্রতিটি অপরাধ মৃত্যুদ-ের দাবি করছিল, তবুও করুণার মূর্তপ্রতীক রাসূলুল্লাহ সা: আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘ভয় করো না, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সা: প্রতিশোধ গ্রহণের অনেক ঊর্ধ্বে।’ তিনি তাকে শুধু ক্ষমাই করলেন না; বরং এও ঘোষণা দিলেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সেও নিরাপত্তা লাভ করবে।’
হিন্দা জাহিলিয়াতে উগ্র, বিকৃত ও চরম হিংস্র্র মানসিকতার এক মহিলার নাম। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী। উহুদে যিনি তার বান্ধবীদের নিয়ে রণোন্মাদনার গান গেয়ে কুরাইশ সেনাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল। রাসূলুল্লাহ সা:-এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন প্রিয়তম চাচা ও ইসলামের বীর যোদ্ধা হজরত হামজা রা:-এর লাশের সাথে চরম বেআদবি করেছিল এই মহিলা। সাইয়েদুশ শুহাদার নাক কান কেটে হার বানিয়েছিল এবং বুক চিড়ে কলিজা বের করে দাঁত দিয়ে চিবোতে চাচ্ছিল। যুদ্ধ শেষে এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ সা: অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন সেও ঘোমটায় মুখ ঢেকে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামনে হাজির হলো। রাসূলুল্লাহ সা: একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করলেন না, তুমি এমনটি করলে কেন? এই সার্বজনীন ক্ষমার অদ্ভুত দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে সে চিৎকার করে বলে উঠল- ‘হে মুহাম্মাদ! আজকের আগে আমার কাছে তোমার খিমার চেয়ে অন্য কারো খিমা অধিক ঘৃণ্য ছিল না, কিন্তু আজ তোমার খিমার চেয়ে প্রিয় খিমা অন্য কারো খিমা নয়।’
ইসলাম, মুসলমান ও স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা:-এর বড় শত্রু ও অত্যধিক কষ্টদানকারী আবু জেহেলের পুত্র হচ্ছেন ইকরামা। সেনও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। মক্কা বিজয়ের সময় নিজের কৃত অপরাধের কথা স্মরণ করে ইয়েমেনে পালিয়ে যায়। তার স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ইয়েমেনে গিয়ে ইকরামাকে অভয় দান করেন এবং সাথে করে মদিনায় নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ সা: তার আগমনের খবর পেয়ে তাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর পবিত্র দেহে চাদরও রইল না। অতপর আনন্দের আতিশয্যে বললেন, ‘হে হিজরতকারী সওয়ার! তোমার আগমন মুবারক হোক।’ কাকে এই সংবর্ধনা? কার আগমনে এই আনন্দ? আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন, যার পিতা মক্কায় রাসূল সা:-কে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে, তাঁর পবিত্র শরীরে ময়লা নিক্ষেপ করেছে, নামাজরত অবস্থায় তাঁর ওপর হামলা করতে চেয়েছিল, তাঁর গলায় চাদর বেঁধে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল, তাঁকে হত্যার পরিকল্পনার মূলমন্ত্র পেশ করেছিল। আর আজ তারই পুত্রের আগমনে এ আনন্দ মুবারকবাদ!
হেবার ইবনুল আসওয়াদ এক দিকে রাসূল-দুহিতা হজরত জয়নব রা:-এর হত্যাকারী ছাড়াও ইসলামের আরো বহু ক্ষতি করেছে। মক্কা বিজয়ের সময় তার রক্ত হালাল ঘোষণা হলে সে ইরানে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিল; কিন্তু পরে কী চিন্তা করে সোজা রাসূলুল্লাহ সা:-এর দরবারে হাজির হলো এবং বলল- হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধৈর্যের কথা স্মরণ করে ফিরে এলাম। আমার অপরাধের যেসব বর্ণনা আপনি শুনেছেন তা সত্য। এটুকু শুনতেই তাঁর রহমতের দুয়ার খুলে গেল এবং তিনি মাফ করে দিলেন।
উমার ইবনে ওহাব বদর যুদ্ধের পর জনৈক কুরাইশ সর্দারের ষড়যন্ত্রে নিজের তরবারিতে বিষ মাখিয়ে মদিনায় প্রবেশ করল এবং সুযোগ মতো রাসূলুল্লাহ সা:-কে হত্যা করার অপেক্ষায় রইল। এই সময়ে হঠাৎ একদিন সে গ্রেফতার হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামনে হাজির করা হলো এবং তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তিনি তাকে মুক্তিদান করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর এ ধরনের আরো বহু ক্ষমার দৃষ্টান্ত রাসূলুল্লাহ সা:-এর রয়েছে। আমাদের নেতৃত্বকে রাসূল সা:-এর সুন্নাহকে অনুসরণ করার অনুরোধ করব।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট